11 March 2012

ইচ্ছে করে চলে যাই অচিনপুর

২৩ জানুয়ারী ২০১৩, দুপুর ০১:৫৫

বন্ধু, তুই ব্যস্ত আছিস বলে ফোনেও পাইনা। এদিকে যত্রতত্র অসহায়ত্বের কবলে পড়ে আছি। ব্যস্ত শহরের এক উঁচু ভবনের কোণে বসে কীবোর্ড চাপছি, ক্ষণে ক্ষণে মোবাইল বেজে উঠছে, বসের ফোনে নির্দেশনাতে কাজ করা। ইচ্ছেই করেনা কিছু করি। যদি পারতাম এই চাকরি বাকরি ফেলে অন্তত হাওয়া হয়ে যেতাম কতদিন। মনে হচ্ছে যেন অনন্তকালের এক অনিঃশেষ যন্ত্রণাতে বসে আছি। অথচ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেই আছি। উত্তাপ অবধি নেই।


বন্ধু, তুই জানিস কতবার কত ইচ্ছে হয়েছে জীবনে দারুণ কিছু করার। আমি সবসময়েই প্রচন্ড হোঁচট খাই। উঠে দাঁড়াতে পারিনা কেন বলতো? অনুপ্রেরণামূলক যত প্রবন্ধ ছিল সবই তো পড়ে ফেলতাম, আমি তো কোনদিন কারো ক্ষতি করতে চাইনি সে তুই জানিস। অথচ আমি এই ধোয়া আর ধূলার শহর ছেড়ে বাইরে কোথাও যাবো সে জায়গা আমার নেই। খরচ করবার সাহস নেই। মাস ধরে অসহ্য যন্ত্রণার কাজ করে যেই পয়সা পাই, তা তো ভাড়া, বাজারেই চলে যায়।

তোর সাথে সেদিন দেখা হলো অল্প কিছুক্ষণ। দু'টো কথা বলতেই ধুম করে বলতে লাগলি, আর কি কেউ চাকরি করেনা? আমি তো চাকরি করছিই, যেটুকু না করলেই নয় সেও তো করছি। অথচ দুই যুগ অবধি কখনো কি আমি এমন ছিল যেদিন আমি ক্লাসে যাইনি? নিজেকে তো কখনই প্রশ্রয় দিইনি। তখন তো মনে হতনা আমি বুলডোজারের নিচে চাপা পড়ে আছি। মা-কে দু'কথা বললেই তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। সারাটা জীবন যিনি কেঁদেই কাটালেন, তাকে আর কিছু বলার উপায় নেই। উপায় নেই ভাইয়াকে বলার। দু'শব্দ উচ্চারণের আগেই আমাকে দায়িত্বহীন মূর্খ অলস বলে গালি দেয় সে প্রতি সপ্তাহেই। কান খাড়া বলে দুই ঘর পর থেকেও শুনতে পাই। স্নেহের আলাপ বলে ভেবে থাকলেও এখন বুঝি, সে আমার কপালেরই আরেক রূপ। আপুকে সেদিন চিঠি লিখে পাঠালাম। একটানা কয়েকটা। সে ক্ষেপে গেলো। আমার এইসব চিন্তাভাবনা তার সহ্য হয়না। আমি নাকি বেশি বেশি করি। আমার অভিমানের কথা না বুঝে যখন ক্ষেপে গেলো, তখন আমিও মানে মানে ক্ষমা চেয়ে সরে আসতে চাইছিলাম।

আমাকে তো সেদিন বললি রিয়ালিস্ট হতে। কীভাবে রিয়ালিস্ট হতে হয়? আমি কী ধরে স্বপ্ন দেখব বলতে পারিস? একটা অবলম্বন থাকতে হয় স্বপ্ন দেখতে। আমার বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে হয়না। ক্রমাগত যুদ্ধ দেখেছি, করেছি। আমার আর জগতের কিছুর প্রতিই আকর্ষণ হয়না। আমাকে নিয়ে একসময় অনেকেই হয়ত উদাহরণ টানবে -- নষ্টের উদাহরণ। আমি জীবনে কখনো সজ্ঞানে কারো ক্ষতি করিনি জানিস? সবসময়ে কষ্ট হলেও নিজে সরে গিয়েছি। আমার কাছে কেউ এলে কখনো কাউকে ফিরিয়ে দিইনি, সাধ্যমতন সাহায্য করেছি। আমার কেন এমন হয় বলতে পারিস? তুই যেদিন এলোমেলো হয়ে এলি, আমার দু'দিন বাদে পরীক্ষা ছিল তবু দিনের অর্ধেকটা তোকেই দিয়েছিলাম। তোকে সেদিন বললাম যখন, তুই দু'সপ্তাহ ধরেও আর সময় পেলিনা।

আমি জীবনে হাজার হাজার লাইন লিখেছি জানিস তুই? আমার সাধ্য ছিল ওতেই। ইচ্ছে ছিল নিজের সবটুকু নিংড়ে লিখে দেব অক্ষরে অক্ষরে। আমার ক'দিন যাবত মনে হচ্ছে আমার সবটুকুই শেষ। ডায়েরি নোটবুক আর ব্লগের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমার শত্রু-মিত্র যারাই থাকুক, আমি হারিয়ে গেলে আর জগতের তেমন কিছু আসবে যাবেনা। কত মানুষই তো দেখলাম, বিচারপ্রবণ। দু'কথা শুনেই ভালো-মন্দ ঘোষণা দিয়ে বসে। প্রায়ই শুনি এমন, প্রিয়জনদের কাছে। বুক এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেলেও চুপ করে বসে থাকি। আমাকে বাজে কথা বলেও তারা বিরক্ত হয়ে ওঠেন আমার উপরেই। কী অদ্ভুত নিয়তি!

এমন চিঠি আমি লেখিনি কোনদিন, হয়ত ডায়েরি ঘেঁটেও পাবিনা। আজকে কেন লিখছি? আমার হারাবার ভয় হারিয়ে গেছে বলেই হয়ত। স্বপ্ন দেখতাম আমি বদলে যাব, আমি অনুপ্রেরণার একটা অবলম্বন পাব একদিন। সেটাকে আশ্রয় করে আমিও একদিন অনেক কর্মপ্রাণ হব। অনেকগুলো সময় আর ধাক্কা খেতে খেতে বুঝেছি, শেষ স্বপ্নটুকুকে জিইয়ে রেখে যতদূর এসেছিলাম, কখনোই আর কিছুই মিলবে না। অফিসের আগামী সপ্তাহের সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে হয়ত আমাকে চাকুরি ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হতে পারে। টেনেটুনে জীবন পার করে দিতে হয়ত পারব। পারব না নিজের জন্য কিছু করতে, অন্যদের জন্য তো সুযোগই নেই।

আবীর , তোর মনে আছে এসএসসি আগে তোকে একটা চিঠি দিয়েছিলাম? 'বাঁধন হারা' বইটি পড়ে আমার চোখের পানি ঝরেছিল ঝরঝর, সেকথাও তোকে লিখেছিলাম। হতভাগা নূরুল হুদার সাথে আমার এত মিল এলো কোত্থেকে তা এই একযুগ পর টের পাচ্ছিনা। তোর মনে আছে নূরুল হুদার কথা? মরুগামী সৈনিকদের প্লাটুনে করে সে চলে গিয়েছিল ইচ্ছে করেই। হয়ত আর ফেরেনি কখনো। আমি তো ইচ্ছে থাকা সত্বেও সৈনিক হতে পারিনি। হলেই ভালো হত। সিয়েরা লিওন বা কঙ্গোতে চলে যেতাম। মা-বাবাও আমার চলে যাওয়া নিয়ে দুঃখ করত না। ভাইবোনেরাও বুঝতে এই যাত্রাকে না বলা যাবেনা। পেছনে দু'কথা বলে গালাগাল করতেও পারত না। ভালোবাসা যখন পেলাম না, গালাগালটাও পেতে চাইনা।

হতভাগা নূরুর লেখা শব্দগুলো মনে আছে আমার। বয়ঃসন্ধির ভালোবাসাগুলো আমার সব ছিনতাই করেছিল কাজীদা। নূরু বড্ড দুর্ভাগা ছিল রে! অমন করে আমি আর কারো জন্য কাঁদিনি। সাতকাহনের দীপাবলীর কষ্টেও না, পূর্ব-পশ্চিমের অতীনের জন্যেও না। অতীন যখন মার্কিন মুলুকে আকাশচুম্বী ফ্ল্যাটে বসে শর্মিলাকে ফোনে পাচ্ছিলনা, বাবা মরে যাচ্ছিল টের পাচ্ছিলো -- সেই দৃশ্য মনে পড়লেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায় আমার। আমার দেশ ছেড়ে যেতে মন চাইত না। নূরুল হুদাও হয়ত দেশ ছেড়ে যেতে চায়নি। কিন্তু ওর ফেরার জায়গা ছিলনা রে। আমারো হয়ত অমনই হচ্ছে। নূরুর বড়ো ভাবী কেবল ওকে স্নেহ করতেন একটু। স্নেহ বলতে আর কারো কাছে সে পায়নি। নূরুর তো তবু সুস্থ শরীর ছিল। অথচ আমি ও হাঁটতেও পারিনা সোজা হয়ে শক্ত করে। আমার পালাবার উপায়ও নেই কোন।

যাযাবরের দৃষ্টিপাতের কয়েকটা লাইন ঘুরে-ফিরে বড্ড মনে পড়ে। আমার তো নিজেকে বরাবরই মূর্খ মনে হত। কী অদ্ভুত দেখেছিস? আজ এত বছর পরে প্রতিটি খন্ড খন্ড ভাবনাকেই একই স্রোতে খুঁজে পাচ্ছি। পড়েছিলি এই লাইনগুলো? বেচারা মিনি সাহেবের জীবনের কষ্টের অনুভূতিগুলো বলতে নিয়ে যাযাবর এই কথাগুলো লিখেছিলেন দৃষ্টিপাতে --

জগতে মূর্খরাই তো জীবনকে করেছে বিচিত্র; সুখে দুখে অনন্ত মিশ্রিত। যুগে যুগে এই নির্বোধ হতভাগ্যের দল ভুল করেছে, ভালোবেসেছে, তারপর সারা জীবনভোর কেঁদেছে। হৃদয়নিংড়ানো অশ্রুধারায় সংসারকে করেছে রসঘন, পৃথিবীকে করেছে কমনীয়। এদের ভুল, ত্রুটি, বুদ্ধিহীনতা নিয়ে কবি রচনা করেছেন কাব্য, সাধক বেঁধেছেন গানচিত্র, ভাষ্কর পাষাণ-খণ্ডে উৎকীর্ণ করেছেন অপূর্ব সুষমা।

জগতে বুদ্ধিমানেরা করবে চাকরি, বিবাহ, ব্যাংকে জমাবে টাকা, স্যাকরার দোকানে গড়াবে গহনা; স্ত্রী, পুত্র, স্বামী, কন্যা নিয়ে নির্বিঘ্নে জীবন-যাপন করবে সচ্ছন্দ সচ্ছলতায়।


বুদ্ধিমান হবার বড় ইচ্ছে ছিলরে। আমার তো মূর্খ হওয়াই নিয়তি। নইলে আজকেও কি রাস্তা দিয়ে সকালে আসার সময় বারবার করে চোখ ভিজতো পথের পাশের মানুষগুলোকে দেখে? তোদের মতন প্রেম করে, বিয়ে-থা করে, ভালো রেজাল্ট করে ব্যাঙ্কে ব্যালেন্স জমানো হয়নি। যখন সবাই প্রেম করত ক্লাস শেষে, তখন হলের দারোয়ান জমির ভাইয়ের সাথে বসে তার পরিবারের গল্প শুনে স্বপ্ন দেখিয়েছি। কয়েক বছর পর যখন হলে গেলাম, জমির ভাই জড়িয়ে ধরে চেপে রেখেছিলেন বুকের সাথে। তুই জানিস বন্ধু, তোরা যখন ব্যস্ত জীবনে সময় বের করতে পারিস না -- ওই মানুষগুলোর কথা ভেবে আমার প্রেরণা হয়।

আমার গ্রাম বলেও কিছু নাই। অথচ খুব সবুজ দেখতে ইচ্ছা করে। আমি জানি আমার কোন স্বপ্ন পূরণ হবেনা। এগুলো তো খুব বড় স্বপ্ন না। আমি কোনদিন চাইনি লাস ভেগাসে যাব, চাইনি নায়াগ্রা দেখব। অনিমেষের আংরাভাসার মতন করে যদি আড়িয়াল খা, ভৈরব, মহানন্দা দেখতে পেতাম পাড়ে বসে -- তবুও চলত। কেন এমন হয় রে? কেন কিছু মানুষের জীবন সবসময়েই সাদাকালো হয়? আমি আর কতগুলো বছর অপেক্ষায় থাকব বল? সজ্ঞানে প্রায় এক যুগ পেরিয়ে গেলো এই অন্ধকারে।




উইনিং-এর সেই গানটা মনে আছে তোর? গানটার কথা মনে পড়ে আমার। শহরের জঘন্য জীবনের মাঝে চেয়ারে বসে কল্পনায় আমার ছেলেবেলার বাঁশের সাঁকো, সরিষার ক্ষেত, আখের খেতের সারির পরে সেই বড় খাল পেরিয়ে দৌড়ে যাবার একটা দু'টো স্মৃতিকে সাথে করেই প্রাণস্পন্দন পাই। চলে যাব জানি একদিন। নিজের হাতে কিছু নেই, যাবার আগে অনন্তের প্রস্তুতি নিতে হবে। এই অদ্ভুত বেড়াজালগুলো না থাকলে কবেই বিদায় চাইতাম।


ইচ্ছে করে যাই চলে যাই অচিনপুর
যেখানে দুঃখ নেই কষ্ট নেই
ঝলমল করে আলো রোদ্দুর…..
ইচ্ছে করে হাঁটি এলোমেলো মেঠো পথ ধরে
গানের সুরে ছন্দে মাতি ইচ্ছে করে

শহর থেকে একটু দুরে
ছায়া ঘেরা মোঠো পথ পেড়োলেই
ছায়াঘেরা নদী শ্যামল সবুজ বন
ইচ্ছে করে দেখি ভরে এই দু’ নয়ন

ক্লান্ত লাগে নগর জীবন
কৃত্রিম প্রেমে বিষন্ন এ মন ।।
ইচ্ছে করে সাগর পারে সন্ধ্যা বেলা
দেখি সূর্যডোবা দেখি বালুকাবেলা
জোৎস্না রাতে তারার মেলায়
নিমগ্ন একা

হেঁটে যাই চলে যাই অনেক দুর
যেখানে দুঃখ নেই কষ্ট নেই
ঝলমল করে আলো
রোদ্দুর…..




অচিনপুরে যাবার উপায় নেই হয়ত। আমার তাই চাওয়াগুলো সব অধরাই থাকবে। নদীর পাড়ে বসে নিশ্চিন্তে মুখ ভেজাতে পারব না পানিতে। ধানের ক্ষেতে হেঁটে যাওয়া একটা বেলা। জীবনের দায়িত্বগুলো কাঁধে এসে চেপে বসছে। প্রৌঢ়ত্বের জীবন চলে এলেও বাল্যের আনন্দকে স্পর্শ করা হয়নি এই জীবনে। আমি আর কখনো কারো উপরে ক্ষেপে কথা বলব না ঠিক করেছি। যার জীবনের সবটুকু অপূর্ণ, সে কীসের অধিকারে আর কাউকে সঠিক হতে বলতে পারে বা তাদের অল্প কিছু অপূর্ণতাকে তিরষ্কার করতে পারে? সে যাকগে, বন্ধু, নিয়ে যাবি আমায় অচিনপুরে? আমি মরে গেলে আমাকে অন্তত সবুজের মাঝে উন্মুক্ত কোন প্রান্তরে নিয়ে কবর দিস।


ইতি,
তোর হতভাগা বন্ধু
নিবিড়