28 November 2012

মিশরের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মুসলিম ব্রাদারহুড এবং প্রেসিডেন্ট মুরসির বিগত পাঁচ মাস : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

মিশরে একটা উত্তাল সময় চলছে। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মুরসি আরেকটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। হোসনি মুবারকের ৩২ বছরের শাসনামলের পতনের পর থেকেই কিছু শাসনযন্ত্রীয় জটিলতায় ভুগছে মিশর। প্রকান্ড সেইসব সমস্যা নিয়ে একটি দেশের প্রশাসনকে চালু রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে। তবে ইতিমধ্যে তিনি সমস্ত সমস্যাই সফলতার সাথেই অতিক্রম করেছেন।  মার্কিনী ও ইসরাইলিদের বন্ধুসুলভ সরকার ছিলো হোসনি মুবারকের প্রশাসন। ভৌগলিক কারণে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কারণেও মিশর সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।



২৫ জানুয়ারির সেই আন্দোলনের পর মুবারকের পতন অনিবার্য হয়ে যায়। সেই বিক্ষোভ ও আন্দোলনে সকলেরই অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। পরবর্তীতে দেশে নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড মুভমেন্টের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে এবং সালাফি আল-নূর পার্টির সাথে পার্লামেন্ট গঠন করে। সেই সময়ে হোসনি মোবারক ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও প্রশাসনের সমস্ত ক্ষেত্রেই ছিল মোবারকপন্থী লোক। তখন দেশের সর্বময় ক্ষমতা ছিলো SCAF সুপ্রিম কাউন্সিল অফ আর্মড ফোর্সেস এর হাতে, যার প্রধান ছিল ফিল্ড মার্শাল হুসেইন তানতাওয়ি, মোবারকের একনিষ্ঠ সহযোগি। দীর্ঘকাল চড়াই উতরাই পেরিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এগিয়ে আসে, সুপ্রিম কাউন্সিল আয়োজন করে নির্বাচনের। কিন্তু নির্বাচন পূর্ববর্তী বিভিন্ন রকম নিয়মকানুনে প্রেসিডেন্ট পদের প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়েন অত্যন্ত জনপ্রিয় সালাফি নেতা শায়খ হাজেম সালাহ আবু ইসমাইল এবং মুসলিম ব্রাদারহুদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও প্রখ্যাত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খায়রাত আল শাতের। ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির হয়ে দ্বিতীয় নমিনেশন ছিলেন ডক্টর মুরসি। 

আন্দোলন করে একনায়কের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা জনগনের সামনে তখন ছিলো মূলত চারজন প্রতিযোগি -- ব্রাদারহুডের নির্বাচিত মুহাম্মাদ মুরসি, ব্রাদারহুড থেকে প্রত্যাখ্যাত অপর নেতা আব্দুল মুনিম আবুল ফুতুহ, বামপন্থী সেকুলারদের পছন্দ আমর মুসা এবং মোবারকের সময়ে প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক। আবুল ফুতুহ এবং আমর মুসার জনপ্রিয়তা খুব একটা ছিলো না। দেশের জনগনের সামনে ছিলো মূলত দু'টি পছন্দ -- আহমেদ শফিক এবং মুহাম্মাদ মুরসি। অকল্পনীয়ভাবে ভোটের ফলাফলে আহমেদ শফিককে এগিয়ে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠে জনগণ। তবে, এখানে ব্রাদারহুডের কাজ ছিলো সুনিপুণ এবং সূক্ষ্ম। প্রতিটি কেন্দ্রে ছিলো তাদের উপস্থিতি, যারা কেন্দ্রের ফলাফলগুলোর রেফারেন্স কপি প্রমাণসহ রেখে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে রক্ষনাবেক্ষন করে ফেলে। যেকোন সরকারি বেসরকারী সংগঠন ফলাফল হিসেব করতে বসার আগেই ব্রাদারহুদের রাজনৈতিক দল এফজেপির পক্ষ থেকে নির্বাচনী ফলাফলের একটি বই প্রকাশ করা হয়ে যেখানে ৫১ ভাগ ভোট এককভাবে পেয়েছিলেন ড মুরসি। নিয়মানুযায়ী প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই ৫০% এর বেশি ভোট পেতেই হবে। যদিও আহমেদ শফিক ভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করেছিল এবং তার পক্ষেই ছিল মিশরের ক্ষমতার উৎস সুপ্রিম কাউন্সিল অফ আর্মড ফোর্সেস। তবু শেষ পর্যন্ত সেই ষড়যন্ত্র নস্যাত হয়ে যায় কিছু ঐতিহাসিক মূহুর্তের কাছে।  ফলাফল প্রকাশের দিন জনগণ আতঙ্কিত ছিল। আহমেদ শফিকের কাছে প্রেসিডেন্সি যাওয়া মানে আবার সেই পুরোনো চক্রে হারিয়ে যাওয়া মিশরের মানুষের চাওয়া পাওয়া। সেদিন তাহরির স্কয়ারে মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে সকাল থেকেই। ফলাফল প্রকাশের পর চিৎকার করে ওঠে সারাদেশ, হয়ত সারাবিশ্বেই। মুরসির প্রেসিডেন্সিতে আবেগাপ্লুত হয়ে আনন্দিত হয়েছিল তখন দেশের সালাফি-ইখওয়ানি-সেকুলার-খ্রিষ্টান সকলের। এদিকে পার্লামেন্ট নিয়ে কিছু নাটকীয়তা হয়। পার্লামেন্ট নির্বাচনকে অকার্যকর ঘোষণা করে বিচারবিভাগ -- ফলে নতুন সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা পুনরায় সুপ্রিম কাউন্সিলের হাতেই থাকে। প্রেসিডেন্টকে পুতুল বানিয়ে ফেলার পথ তৈরি করার দিকে এগিয়ে যায় প্রশাসন। মুরসি সেই সময় বুদ্ধিমান ও চৌকস প্রেসিডেন্টের মতন হাল ধরেন। সুপ্রিম কাউন্সিল অফ আর্মড ফোর্সেস তাদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করার আগেই তার প্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাওয়ি এবং সেনাপ্রধান সামি আদনানকে অবসরে পাঠানো হয়। তবে তাদেরকে তিনি দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা 'অর্ডার অব নাইল' পদকে ভূষিত করেন এবং সুচারুরূপে পরিস্থিতি সামাল দেন সেনাবাহিনীর মাঝে অরাজকতা তৈরি হওয়াকে এবং সর্বোপরি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জটিলতা সৃষ্টি থেকে। সুপ্রিম কাউন্সিল অফ আর্মড ফোর্সেস এর নতুন প্রধান করা হয় আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি, যিনি একই সাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্বপালন করবেন।  এরপর দেশের অর্থনৈতিক এবং সামগ্রিক পুনর্গঠনে মন দেন মুরসি। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আক্রমণে প্রায় দুই শতাধিক প্রাণহানি হয় এক সপ্তাহে, মুরসি সতর্ক হুঁশিয়ারি দেন ইসরাইলকে, কূটনীতিবিদকে দেশে ফিরিয়ে আনেন ইসরাইল থেকে। পরবর্তীতে তার মধ্যস্থতায় ইসরাইল আক্রমণ বন্ধ করার চুক্তি করে হামাসের সাথে। এই কাজটি প্রশংসিত হয় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে।

এই সময়েই বিভিন্ন গোপন সূত্রে মুরসি প্রশাসনের কানে আসে বিচার বিভাগ প্রেসিডেন্টকে অকার্যকর ঘোষণা করে পুনরায় সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় আনবে। এরপরেই মুরসি ডিক্রি জারি করেন, যার মাধ্যমে তিনি বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তগুলো প্রেসিডেন্টের আওভাভুক্ত করেন। জেনারেল প্রসিকিউটর মেগুইদ মাহমুদকে তিনি প্রত্যাহার করেন। এই ডিক্রির ফলে প্রেসিডেন্টের হাতে বিশাল ক্ষমতা বিচার বিভাগের স্বেচ্ছাচারীতা আর সম্ভব নয়।  এই ডিক্রির পজিটিভ দিক হল -- এর ফলে মোবারকের সময়ে করা হতাকান্ডগুলোকে বিচারের আওতায় আনা যাবে। যা পূর্বে বিচারবিভাগ রহিত করে দিয়েছিল। ফলে পূর্বেকার হিসেবে মোবারক এবং তার প্রশাসনের সবাই বিচারের বাইরে চলে গিয়েছিল। হোসনি মোবারকের পতন আন্দোলনে জড়িত সবাই এই সিদ্ধান্তে আনন্দিত হয়েছে, আনন্দিত হয়েছে দেশবাসী, যা চলমান সকল জরিপেই দেখা যাচ্ছে। এই ডিক্রির ফলে পজিটিভ মতামত দিচ্ছেন বোদ্ধারা, কেননা এর ফলে মিশরে দীর্ঘদিন যাবত চলে আসা প্রেসিডেন্ট-প্রশাসন-বিচারবিভাগের ক্ষমতার গোলক-ধাঁধা একটি পরিচ্ছন্ন রূপ পাবে। 

প্রেসিডেন্ট মুরসি এবং তার প্রশাসন জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্টের এই ক্ষমতা কেবলই অল্প সময়ের জন্য নেয়া হয়েছে, যা কেবল বিবাদমান জটিল পরিস্থিতির সমাধানের জন্য। মিশরের রাজনৈতিক বোদ্ধা এবং সমালোচকরা এই সিদ্ধান্তকে বলিষ্ঠ ও বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে করছেন। তবে এরপরেও দেশে ভাংচুর হচ্ছে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক দল এফজেপির অফিসগুলো। অরাজক পরিস্থিতিকে উসকে দিচ্ছে বামপন্থী সেকুলার কিছু দল, যার মনে করছে এই ক্ষমতা ইসলামিক দলগুলোর হাতে চলে গেলো।

এছাড়া মোবারকের মদদপুষ্ট বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে থাকা লোকেরাও এই ডিক্রি ঘোষনার পরবর্তী সহিংসতায় উসকানিমূলক ভূমিকা রাখছে। শেষ খবর জানা পর্যন্ত, প্রেসিডেন্ট মুরসি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন, আলোচনার জন্য তিনি বিচারবিভাগের উর্ধতন অনেকের সাথে সংলাপের জন্য ডাক দিয়েছেন।  মোটকথা, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির একটা কন্ট্রোল মিশরের উপরে হওয়ায় দেশের এবং বাইরের অজস্র শত্রুভাবাপন্ন, কূটকৌশলী ও কূটনৈতিক সমস্যাকে মোকাবেলা করে, ইসলামি রাজনীতি নিয়ে শত্রুভাবাপন্ন আরেক জনগোষ্ঠিকে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে মোকাবেলা করে তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার কঠিক কাজটি করতে হবে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে। তার সামনের সময়কে সহজ বলা যাবে না। তবে, মুসলিম ব্রাদারহুড এবং এফজেপি এখন পর্যন্ত বিগত দু'বছর ধরে প্রায় সবক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কৌশলে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আগামীতে কীভাবে তারা এই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা করে -- তা দেখার বিষয়। 


 সাম্প্রতিক লিঙ্কঃ দি অ্যারাবিস্ট আর্টিকেল - ইসান্দার আল আরমানির লেখা 

রাশিদ আল ঘানুশি : তিউনিশিয়ার ইসলামি রাজনৈতিক আন্দোলনের পথিকৃৎ



রাশিদ আল ঘানুশি একজন ইসলামি স্কলার এবং রাজনীতিবিদ। তিউনিশিয়ার ক্ষমতাসীন দল এবং সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক আন্দোলন "আননাহদা মুভমেন্টের" প্রতিষ্ঠাতা তিনি। রাশিদ আল ঘানুশিকে আন নাহদার "স্পিরিচুয়াল লিডার" বলা হয়ে থাকে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধর্মনিরপেক্ষ, একদলীয় শাসনব্যবস্থায় বিরক্ত জনগণের কাছে ঘানুশির আননাহদা মুভমেন্ট তিউনিশিয়ার মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পায় এবং ফলশ্রুতিতে নির্বাচনে জনসমর্থন পেয়ে কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে আরো কয়েকটি দলের সাথে। রাশিদ ঘানুশির মুভমেন্টের নাম "আন-নাহদা", যে শব্দটির অর্থ রেঁনেসা বা পুনর্জাগরণ।



রাশিদ আল ঘানুশি দক্ষিন তিউনিশিয়ার কাবিস অঙ্গরাজ্যের আলহামা সংলগ্ন এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪১ সালে। কলেজ পর্যায়ের শিক্ষাগ্রহণ শেষে তিনি কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এগ্রিকালচারে শিক্ষাজীবন শুরু করেন ১৯৬৪ সালে। কিন্তু মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দেল নাসের এবং তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট হাবিব বোরগুইবার সমস্যার কারণে তিনি সিরিয়ায় চলে যান। সেখানে ইউনিভার্সিটি অফ দামস্কতে দর্শনের উপরে পড়াশোনা করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি গ্রাজুয়েশন করেন। দামেস্কতে থাকার সময় তিনি সমাজতান্ত্রিক পার্টিতে যোগদান করেন। পরবর্তী জীবনে তিনি ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঝুঁকে পরেন।


তিউনিশিয়ার সেকুলার পাশ্চাত্যপ্রেমী প্রেসিডেন্ট হাবিব বোরগুইবার শাসনের বিপরীতে কোন রাজনৈতিক দলই ছিলনা দেশে। ঘানুশি আল-ইত্তিহাদ-আল-ইসলামি বা ইসলামিক টেনডেন্সি মুভমেন্ট নামের একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন। যেই দলটি নিজেদের বর্ণনায় বলে এটি "নন-ভায়োলেন্ট' ইসলামের উপরে প্রতিষ্ঠিত এবং তারা আহবান জানায় অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়ে একটি সমন্বয়পূরণ জীবন গঠনের জন্য। তারা বলেছিলো একদলীয় রাজনীতির অবসান করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নিতে তারা জনগণকে আহবান জানায়।

জুলাইয়ের শেষে ঘানুশি এবং তার সহযোগীরা গ্রেফতার হন এবং ১১ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করে বিজার্ত কারাগারে পাঠানো হয় এবং সেখানে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করা হয়। সেইসময় ধর্মীয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ কমিউনিটিরা সহ অজস্র রাজনৈতিক সংগঠন তার পক্ষ অবলম্বন করে মুক্তির জন্য র‍্যালি করে। ১৯৮৪ সালে তাকে কারামুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৮৭ সালে রাশিদ আল ঘানুশিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করে আবার বন্দী করা হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি মুক্তি পান এবং রাজনৈতিক নির্বাসনে ইউরোপে চলে যান।




[ছবি : ১৯৮০ সালে একটি ইসলামিক র‍্যালিতে বক্তব্য রাখছেন ঘানুশি]

ফিলিস্তিনের জন্য ইসলামিক কমিটির পক্ষে আয়োজিত কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেন ১৯৮৯ সালে। ১৯৯০ সালে কুয়েতের উপরে আক্রমনের পর তিনি সৌদির বাদশাহ ফাহাদকে জঘন্য অপরাধকারী হিসেবে অভিযুক্ত করেন আমেরিকার সৈন্যদেরকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানোর অভিযোগে।

ইউরোপে গিয়েও ঘানুশি বোরগুইবার পরবর্তী শাসক জাইন আল আবেদিন বেন আলির বিরুদ্ধে সমালোচনা করতে থাকেন। কিন্তু জানুয়ারি ২০১১ এর পরে তিউনিশিয়ার গণমানুষের আন্দোলনে একনায়ক বেন আলির পতনের পরে তিনি দেশে ফিরে আসেন ২০ বছরের নির্বাসন ভোগের পরে। দেশে ফিরে নির্বাচনপূর্ব জনমত গঠনে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ভ্রমণ করেন, বিশেষজ্ঞরা তার এই কাজটিকে সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় বলে অভিহিত করে নির্বাচনের পরে। কেননা একনায়ক শাসনের পরে আননাহদার সমান সংগঠিত হয়ে উঠতে পারেনি আর কোন রাজনৈতিক দল।

২০১১ সালের ২২ জানুয়ারিতে আল জাজিরা টিভির সাথে একটি সাক্ষাতকারে রাশিদ ঘানুশি বলেন, তিনি জোরপূর্বক হিজবুত তাহরিরের মতন ইসলামি খিলাফত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একমত নন। বরং তিনি উন্নয়নমুখী উদার ইসলামিক ভিত্তির উপর দাঁড়ানো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী, তিউনিশিয়ায় দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা সেকুলার জীবনব্যবস্থায় ভুক্তভোগী জনগনকে ২০১১ আন্দোলন করতে বাধ্য করা জনমানুষের অন্তরকে ইসলামের প্রতি নরম করবে। সৌদি আরব এবং ইরানে শাইখ রাশিদ আল ঘানুশির প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে।

তিনি সকল তিউনিশিয়ানের সমতা আনয়নের ব্যাপারে জোর দেন, বিশেষ করে নারীদের। এছাড়া তিউনিশিয়ার জনগণের মত গ্রহণের জন্য একটা সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। গণতান্ত্রিক অ্যাপ্রোচ ঘানুশিকে অন্যান্য হাই-প্রোফাইল ইসলামপন্থীদের চাইতে আলাদা করেছে, যদিও তিনি মধ্যপ্রাচ্যে অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নেয়ার উপর জোর দিয়ে থাকেন।

২০১১ সালের মে মাসে একটি সাক্ষাতকারে ঘানুশি বলেন, ফিলিস্তিনের আসল সমস্যা রয়েছে গোটা উম্মাহর হৃদয়ে। আর সেই হৃদয়ের অংশটুকু হলো মক্কা থেকে জেরুজালেমের মাটি -- যা ইসলামিক উম্মাহর হৃদয়। তিনি বলেন, এই এলাকার যেকোন বৈদেশিক হস্তক্ষেপই মুসলিম উম্মাহর অন্তর রোগাক্রান্ত হবার লক্ষণ। তিনি আরো বলেন, ইসরাইল খুব শীঘ্রই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।



রাশিদ আল ঘানুশিকে বলা হয় একজন "থট লিডার" যিনি ইসলামিক পদ্ধতিকে সমনাগরিক অধিকারের সাথে সমন্বয় করেছেন। নির্বাচনের আগেই ১৯ এপ্রিল, ২০১১ তারিখে মধ্যপ্রাচ্যের 'দি মাজাল্লা' পত্রিকার সাথে সাক্ষাতকারে ঘানুশি কিছু কথা বলেন। পুরনো সেই সাক্ষাতকারের চৌম্বক অংশ তুলে ধরা হলো --

দি মাজাল্লা: একদম প্রথমে বলতে চাই, নির্বাসন কাটিয়ে দেশে ফেরার পরে তিউনিশিয়ার কী কী পরিবর্তন দেখছেন? দেশে কি নতুন কোন যুগের সূচনা হয়েছে?

রাশিদ আল ঘানুশি: পরম করুণাময় এবং অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি, আর দরুদ ও সালাম পেশ করছি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি। নিঃসন্দেহে নির্বাসন থেকে বাড়ি ফেরার পর আমার অবস্থান বদলে গেছে। আগে আমার অন্তরে আমার দেশ থাকলেও আমি সমস্যাগুলো বাইরে থেকে সমাধানের চেষ্টা করতাম। এখন আমি আমার নিজের মাটিতে এবং এর ফলে আমি দেশের সমস্যাগুলোর অনেক কাছাকাছি থাকছি ও দেখছি ভিন্নরকম করে।


দি মাজাল্লাঃ তিউনিশিয়ার গণআন্দোলনের পেছনে আন-নাহদার ভূমিকা কী ছিলো?

রাশিদ আল ঘানুশিঃ আমরা আন্দোলনের একটা অংশ। যেহেতু গত শতাব্দীর শেষ তিনি দশকে আমাদের ভোগান্তি ছিলো সর্বোচ্চ। আমাদের প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ কারাবন্দী হয়েছিলো, যারা যুগ যুগ ধরে নানা রকম নির্যাতন সহ্য করেছে। শত শত লোক পঙ্গু হয়ে পড়েছেন এবং অনেকজন মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের পরিবার দেখেছিলো করেছিলো নির্মমতা, তারা এতটাই লাঞ্ছনা-গঞ্জনা পেয়েছিলো যে আমাদের তিউনিসিয়াতে আমাদের আন্দোলনকর্মীদের প্রতিটি পরিবারে কেউ না কেউ কারারুদ্ধ হয়েছিলো, নয়ত নির্বাসিত হয়েছিলো, আর নাহয় তাদের তাদের শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছিলো। এই নির্যাতন ও জুলুমের প্রভাব পড়েছিলো একনায়ক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের জমে থাকা ক্ষোভগুলোকে ক্রমেই বাড়িয়ে দিতে। যার ফলে, ক্ষোভে ফুঁসে থাকা এই মানুষগুলোর চেতনার বারুদে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলো জালিম সরকারের বিরুদ্ধের এই আন্দোলন। এই আন্দোলন তাই কেবল আমাদের সংগঠনের সদস্যদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিলো না বরং তিউনিশিয়ার সমাজের সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ

দি মাজাল্লাঃ অতীতের দীর্ঘ তিক্ত সময়ের পরে আন্দোলনের অবস্থা কী এখন?

রাশিদ আল ঘানুশিঃ আননাহদা আন্দোলন স্তিমিত হয়ে গিয়েছিলো ২০বছর ধরে ব্যাপক ধড়পাকড়ের ফলে। যারা কারাভোগ করেননি তারা নির্বাসনে ছিলেন। আন্দোলন শুরু হবার পূর্ব পর্যন্ত বিগত কয়েকবছরে কিছু সদস্য জেল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু তারা ছোট কারাগার থেকে বড় কারাগারে যাবার মুক্ত হয়েছিলেন। তাদেরকে পুলিশের সার্বক্ষণিক প্রহরায় রাখা হয়েছিলো। তারপরেও তারা নিজেদের জীবন শুরু করতে পেরেছিলেন এবং আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এখন আমরা আমাদের কর্মপদ্ধতি পুনর্গঠন করছি এবং নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে আবেদন জানিয়েছি। একটা ভালো উত্তর আশা করছি।

দি মাজাল্লাঃ এখনকার তিউনিসিয়া এবং আন-নাহদার রাজনৈতিক চিত্রটি কেমন?

রাশিদ আল ঘানুশিঃ আমরা তিউনিসিয়ার রাজনীতি ও সমাজের একটা অংশ। এখন আমরা এমন একটা সময় পার করছি যখন আমাদের নতুন একটা রাজনৈতিক সিস্টেম দাঁড় করাতে হবে। একই সাথে, তিউনিসিয়ার মানুষেরা একদলীয় শাসন এবং মাফিয়ার থাবা থেকে মুক্ত হবার এই সময়ে যেটা চাইছে তা হলো—একটি জনগণের দেশ। দেশটি অনেক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং আমরা তার সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির একটা অংশ। আমাদের সকল মানুষের অংশগ্রহণে গড়া এই আন্দোলনকে ধারণ করতে এবং জনমানুষের একটা দেশ স্থাপন করতে আমরা জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে যোগ দিতে। এটি হবে আন্দোলনের প্রথম ধাপের ফলাফল। সব মানুষের অংশগ্রহণে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে এই নির্বাচন ফলপ্রসূ হবে। আন্দোলনের বাইরে থাকা কেউ অথবা পূর্ববর্তী শাসকদের কোন অংশ থাকলে তা সঠিক হবেনা।

দি মাজাল্লাঃ তিউনিসিয়া এবং মিশরের এই আন্দোলন সারা বিশ্বে কেমন প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করেন?

রাশিদ আল ঘানুশিঃ তুরষ্ক থেকে শুরু করে ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া এখন গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আলোকে চলছে। এক্ষেত্রে আরবরা পিছিয়ে ছিলো। এখন তারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে এবংনিজেরা বদলে নিচ্ছে। কিন্তু মিশরীয়দের জন্য প্রথম ধাপটি নেয়ার কারণে তিউনিসিয়া সম্মানিত বোধ করছে। আরবের দেশগুলো এখন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিতে এগিয়ে আসছে।

দি মাজাল্লাঃ আপনি কি মনে করেন ইসলামপন্থীরা সরকার হিসেবে ক্ষমতা পেলে পশ্চিমারা তা মেনে নেবে?

রাশিদ আল ঘানুশিঃ পশ্চিমারা প্রভু নয়।

দি মাজাল্লাঃ সমগ্র বিশ্বের অন্যান্য ইসলামিক সংগঠনগুলো যেমন হামাস, মুসলিম ব্রাদারহুড, আল-কায়েদার সাথে আপনাদের সম্পর্কের ধরণটা কেমন?

রাশিদ আল ঘানুশিঃ আমাদের বিশ্বাস এবং ধর্ম একই, তবে চিন্তাধারা এবং ভিন্ন অবস্থার কারণে আমারা পলিসিতে আলাদা হয়ে থাকতে পারি।




তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়াআননাহদা ওয়েবসাইট [এরাবিক]আল জাজিরা ডট কম : রাশিদ ঘানুশির সাক্ষাতকারবিবিসি -- আননাহদা মুভমেন্টদি মাজাল্লার সাথে সাক্ষাতকার

গাজায় কেন সৈন্য পাঠাচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট মুরসি? : মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি পর্যালোচনা

গাজায় ক'দিন ধরে চলছে চরম মানবিক সংকট। প্রায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি, হাজার হাজার মানুষ বোমার আঘাতে হাসপাতালে আহত। রিফিউজি হিসেবে ফিলিস্তিনি মাটিতে পা দেয়া ইহুদিরা ইসরাইল নামের রাস্ট্র গঠন ও তাকে টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতেই ফিলিস্তিনিদের উপরে এই সামরিক হামলা বলে মনে করেন অনেকে। সেনা, নৌ ও শক্তিশালী বিমান হামলায় বিপর্যস্ত গাজাবাসীর জীবন।

এই পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্ব থেকে উল্লেখযোগ্য কোন সাহায্য দেখা যায়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অঙ্গুলিনির্দেশ যাচ্ছে মিশরের প্রেসিডেন্ট ডক্টর মুহাম্মাদ মুরসির প্রতি। কেন তিনি প্রতিবেশি রাস্ট্র হয়েও কোন সামরিক শক্তি প্রয়োগ করলেন না।  এই প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা প্রয়োজন -- মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকা আবশ্যক একজন মুসলিমের।
আরব রাস্ট্রগুলোর বেশিরভাগ রাস্ট্রই রাজতন্ত্রের মত ব্যবস্থায় ছিল এই শতাব্দীর শুরুতেও। মিশর, তিউনিশিয়া এবং লিবিয়াতে একনায়ক সরকার ছিলো হোসনি মুবারক, বেন আলী এবং মুয়াম্মার গাদ্দাফি। মুবারকের সময়ে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাজনৈতিক জুলুম-পীড়ন পোহাতে হয়েছে ইসলামি মুভমেন্ট করার জন্য। আন নাহদা মুভমেন্ট এর অবস্থাও একই ছিলো তিউনিশিয়াতে। তিউনিশিয়ার মসজিদে বয়স্ক মানুষদের ছাড়া কারো ঢোকার ব্যাপারেও ছিলো কড়া সতর্কতা সরকারী বাহিনীর দিক থেকে। লিবিয়াতে গড়ে ওঠেনি গণমানুষের কোন চেতনা, গাদ্দাফির একক শক্তিতে ৪১ বছরের রাজত্ব ছিলো। সিরিয়ায় বাসার আল আসাদ এবং তার পিতা হাফিজ আল আসাদ উনিশশত সত্তর সাল থেকেই একনায়কতন্ত্র জারী রেখেছিল -- সেখানে জনগণের চিন্তার প্রতিফলন থাকার প্রশ্নই উঠেনা। 

বেন আলীর পতন হয় ফলবিক্রেতা বোয়াজিজি একনায়ক সরকারের প্রতিবাদে গায়ে আগুণ ধরিয়ে আত্মহননের পরের আন্দোলনে। এই আন্দোলনের বাতাস যায় মিশরের তাহরীর স্কোয়ারে। বছর ধরে প্রচুর উত্থান পতনের পর সামরিক সরকারের আশ্রয়ে ও শক্তিতে জারি থাকা হোসনি মুবারকের পতন হয়। মিশরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পেরিয়ে এসেছিলো বিশাল এক পথ পরিক্রমা। এরপর নির্বাচন হয়, এতে হোসনি মোবারকপন্থী সামরিক বাহিনীর প্রবল বিরোধি শক্তি প্রয়োগ সত্বেও চরম নাটকীয়তার পর মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ডক্টর মুহাম্মাদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। এর আগে তিউনিশিয়াতে আন নাহদা মুভমেন্ট সাফল্যের মুখ দেখে, শাইখ রাশিদ আল ঘানুশির দক্ষ নেতৃত্বে জনগনের ভোট পেয়ে আন নাহদা কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে তিউনিশিয়ায়। অনেকেই এই পরিবর্তনকে আরব বসন্ত বলছেন। 

এর পূর্বের ইতিহাসের কথাও মনে রাখা জরুরি। এই সুদীর্ঘ সময়ে, বিশেষ করে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড হাসান আল বান্নার নেতৃত্বে মুভমেন্ট শুরু করার পরবর্তী ৮০ বছরের প্রায় পুরোটাই আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জুলুম ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে আসে। সাইয়েদ কুতুব, জায়নাব আল গাজালিদের মতন অজস্র ত্যাগ স্বীকার করে ইখওয়ানের নেতাকর্মীরা। জামাল আব্দুল নাসের এবং তারপর হোসনি মোবারকের ক্ষমতার সময়ে জনমত গড়ে তোলা নিষিদ্ধ করে রাখা মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল, তবু তারা তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কাজ জিইয়ে রেখেছিল, যোগ্যতা বৃদ্ধি করেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, আধ্যাত্মিক। এই সুদীর্ঘ সময়ে দেশের সবগুলো সেক্টরকেই সেকুলারাইজড করার চেষ্টা করা হয় -- যেমন সেকুলারাইজড করা হয়েছিল তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের শাসনামলে।  আরবের অন্যান্য দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে বেশ কয়টা কারণে যার মধ্যে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা এবং সরকার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ দু'টি বিষয়। বাদশাহ ফয়সাল তেল পাইপলাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাণ উড়ে গিয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে সূক্ষ্ম চালে তাকে হত্যা করা হয়, সৌদি আরবেও শক্তিশালী সত্যভাষী নির্ভীক শাসক আর দেখা যায়না। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোর সবাই আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ককে গুরুত্বের সাথে দেখে। মিশর, তিউনিশিয়ায় চলমান জনপ্রিয় সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্র দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আদর্শিক দিক থেকে সমপর্যায়ের দুইটি মুভমেন্ট মুসলিম ব্রাদারহুড এবং আননাহদার ফসল হিসেবে।

এই অবস্থায় এই দুইটি রাস্ট্রকেই অনেক গভীরে গেঁথে থাকা সেকুলার সোসাইটি এবং সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলোর সৃষ্টি করা ক্রমাগত রাজনৈতিক সংকটকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সেই সাথে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সামলাতে হচ্ছে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে -- মিশরের এই সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছিলো দেশের একনায়কের হাতকে শক্তিশালী করার নিমিত্তে। যখন কেউ বলবে, এই সেনাবাহিনী যুদ্ধ করবে ইসরাইলি বাহিনীর সাথে, যারা বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী, যাদের বিলিয়ন ডলারের অর্থ সাহায্য আসে যুক্তরাস্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ইউরোপ থেকে, তখন একটা বিষয় মাথায় রাখা জরুরি -- এই সেনাবাহিনী গড়েই উঠেছে ইসরাইলি রাস্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং মুসলিম ফিলিস্তিনি রাস্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করার স্পিরিটে। যে বা যারা এই সুস্পষ্ট বিষয়টাকে আমলে না নিয়ে কথা বলেন, নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর স্পিরিট নিয়ে গড়ে ওঠার বিষয়টাতে তারা অজ্ঞ  ইদানিংকালে অনেকেই জিহাদ ঘোষণা নিয়ে একটা তর্ক করছিলেন, তাদের ধারণাই থাকেনা হয়ত যে যুদ্ধের একটা পরিকল্পনা থাকতে হয়। ইসলাম শত্রুর সামর্থ্যের দিকে না তাকিয়ে যুদ্ধ করলেও -- আত্মহননে উদ্বুদ্ধ করে না। অ-ইসলামিক মিশরীয় বাহিনীর সাথে অ-ইসলামিক স্পিরিটে গড়ে ওঠা আর কোন বাহিনীই কোন অবস্থাতে এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারবে না। এই বাহিনীকে গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ। কেবলমাত্র জিহাদি প্রেরণায় গড়ে ওঠা কতিপয় সংগঠন অনেক দেশেই বিরাজমান যারা এইসব ক্ষেত্রে এরদোগান আর মুরসির দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে -- যদিও সকল ক্ষেত্রেই তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গালাগালি দেয়। তাদেরকে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আর অবাস্তব আবেগ থেকে বেরিয়ে এসে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা করা জরুরি। 

প্রেসিডেন্ট মুরসি গাজাতে হামলা হবার প্রথম দিনেই ইসরাইল থেকে রাস্ট্রদূত ডেকে পাঠিয়েছেন, পরিষ্কার গলায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসরাইলকে -- এই দৃশ্যও তো এতদিন এই বিশ্ব দেখতে পায়নি।  আমার মনে হয়, এই মূহুর্তে হামলা বন্ধ করার ব্যাপারে যদি তিনি ভূমিকা রাখেন এবং গাজাবাসী ফিলিস্তিনিদের কাছে ক্রমাগত খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিতকরনের সাথে সাথে অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্য নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আর্থিক, নৈতিক সমর্থন নিতে পারেন -- এই মূহুর্তে এটা একটি বড় প্রাপ্তি হবে। মুসলিম উম্মাহর একজন নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ মুরসির কাছে সবাই বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী পদক্ষেপ দেখতে চায়। 

প্রকৃতপক্ষে, ইহুদিবাদকে উৎপাটন করতে ও রুখতে প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক, সামরিক শক্তি। আধ্যাত্মিক বা স্পিরিচুয়াল উন্নতির আবশ্যকতাও তো অনস্বীকার্য। আমার মনে হয় সামগ্রিক উন্নতি ও প্রস্তুতির সেই সময় অবধি অপেক্ষা করা প্রয়োজন ইসরাইলকে উচ্ছেদের। যদিও এই পথ অবশ্যই অনেক বন্ধুর আর কঠিন হবে।  আশাবাদী কথা হলো, ক'দিন আগে সুদানে সারাবিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়েছে -- মুসলিম ব্রাদারহুডের জেনারেল গাইড ডক্টর মুহাম্মাদ বদি, তিউনিশিয়ার আননাহদা মুভমেন্টের নেতা রাশিদ আল ঘানুশি, হামাসের খালেদ মিশাল, পাকিস্তান জামাআতের সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসানসহ সমগ্র বিশ্বের শতাধিক নেতা একত্রিত হয়েছিলেন -- কথা বলেছেন বিশ্ব পরিবর্তন নিয়ে, উম্মাহকে নিয়ে তারা একসাথে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। পরিবর্তন আসছে এই পৃথিবীতে, সময়ের ব্যাপার মাত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।