21 March 2013

কত কিছু যে হয়ে যায়

সবাই নাকি অনেক কিছু করে। বিশাল প্রতিষ্ঠান বানায়, অট্টালিকা বানায়, কেউ বানায় দেশ, কেউ বানায় জাতি, কেউ হত্যা করে পুরো জাতিকেই, কেউ বিশাল বড় মাফিয়া। কেউ কেউ বিজ্ঞানী, তারা অণুপরমাণূর ভিতরের হিজিবিজিও বের করে এনে পুরষ্কার নেন।

ছোট থেকেই আমি সব দেখি। দেখতে দেখতে ভাষা হারাই। আবেগগুলো আমার গভীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাকে, কিন্তু আমি তবুও নিজের কথা ভাবি। হাত-পা নাড়াতে না পারা, কথা বলতে না পারা হকিন্স কীভাবে লোহিত অপভ্রংশকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে একসময় বিগব্যাং আবিষ্কার করলেন। এই তত্ত্বের না আছে, প্রমাণ না আছে তাকে অসার প্রমাণের শক্তি। তবু শক্তিশালী সেই তত্ব দেয়া লোকটা আমাদের ঢাকা শহরের সর্বনিম্ন পর্যায়ের প্রতিবন্ধীর মতন।

আমি এখনো দেখেই চলি। আমার সাথের ছেলেগুলো অনেক কিছুই আবিষ্কার করে ফেললো। কয়েকটি দেশের বিজ্ঞানীদের সেরা পুরষ্কার পেলো আমারই বন্ধুটা, একই সাথে একই জিনিস পড়লাম, ওর চাইতে আমি বেশি চিন্তা করতে পারতাম একটা সময় পর্যন্ত। তারপরের সময়গুলোই ইতিহাস লিখে দিলো। কেউ এই শহরে পচে মরে, কেউ বিশ্বজয় করে।

সবাই নাকি অনেক কিছু করে, অথচ আমি দেখলাম জীবনভর আমি কিছু করিনি। আমার যা অর্জন তা আমার নয় আসলে, এ সবই হয়ে গেছে। এই জীবনে কতকিছুই দরকার বুঝি। আজ থেকে অনেক কয়টা বছরা আগে যেই সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল -- বন্ধুরা সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবনে এগিয়ে গেছে। আমি আজো স্তব্ধ, পারিনা; আমার চারপাশ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আমার পক্ষে পারাও হবেনা। এই রকম বেড়াজাল আমাকে সামনে পেছনে টেনে রাখে। আমি নির্বিকার হয়ে বসে থাকি।

আমি জানি, কিছুই করিনা আমি। আমার ক্ষমতা কিছুই নেই। যখন অনেক কষ্ট হয় -- তখনো আমি আমার অসহায়ত্বকেই আবিষ্কার করি। যখন কিছু মিছু করে ফেললাম, সমগ্র অফিসে আমাকে নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো -- তখনো আমি জানি, সবাই যেটাকে ভালো বলছে, তার অনেক অনেক ভুল রয়ে গেছে, আমি তাকে উন্নত করতে পারিনি।

অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন ছিল। অথচ আমার শক্তি নেই সিদ্ধান্ত নেবার। হয়ত একদিন মাথা চাপড়াবো। জানিনা। সম্ভবত মাথা চাপড়াবো না। কেননা, ইতোমধ্যেই সেইরকম শত-সহস্র ভুল করে ফেলেছি। আমি জানি, আমার কিছুই করার ছিলো না। আসলে, হয়ত এই তীব্রতম যন্ত্রণাতেও মুখ বুঝে সহ্য করে যাওয়ার মাঝেই নিয়তি। হয়ত এই মুখ বুজে কাউকে শেয়ার না করাটাই আমার ভাগ্যলিখন। যতবার যতজনকেই বলতে গেছি, কেউই বুঝে নাই। আমার ভাগ্যবিধাতা আমাকে পথ করে দেন না। আমিও চুপচাপ থাকি। দুই জীবনের ধ্বংসকে চোখের সামনে এগিয়ে যেতে দেখি। আশাবাদী হতে চাই, আশাবাদী হতে হয়। বড় কোন অপরাধের সাহস পাইনা। আশা করার কোন অর্জনও নাই।

আমি তো আসলে কিছু করিনা। সবই আমার ইচ্ছেটুকুই। এখন যেই তীব্র ইচ্ছা, সেটা কখনো মুখ ফুটে বের হয়নি। যখন উচ্চারিত হলো, চারপাশের আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্য দেখে বুঝেছিলাম -- আমার ক্ষমতা কল্পনাতীত কম। এই আকাশ তুলে স্থাপন করতে পারব না। পারব না নীল আকাশের মাঝে কোন রঙের আবির রাঙ্গাতে। আমার হাতে কিছুই নেই। সবই আমার ক্ষমতার অতীত।

এমনকি এই বাক্যগুলো লেখা? সেটার ইচ্ছাও আমার দু'দিন ধরেই ছিলো। কষ্ট জমতে জমতে যখন একটা এভারেস্ট হয়ে গেলো, তখন তাকে গলে পানির ধারা হয়ে ঝরতে শুরু করেছিলো চিন্তা। সময় আর সুযোগ হয়ে যখন লিখতে ধরলাম, তখনো তো অনেক ভাবনাই হারিয়ে গেছে। এটুকুও না হতে পারত। এটুকু হলেও বেশিকিছু হলো না, আবার কমও হলো না। গাজায় ছোট ছোট শিশুরা কাঁপছে বিমানের হামলার শব্দে, রোহিঙ্গারা হয়ত খোলা আকাশের নিচে শুয়ে, আমি যে কিছুই করতে পারিনা -- এই কষ্টগুলো এসব মানুষদের কথা ভাবলে লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যায়। পালিয়ে যেতে পারেনা, মিথ্যে তো না, কেবল চিন্তার কৌণিক পার্থক্য, সময়ের প্রবঞ্চনায়।

দিনশেষে একটা কথা মনের মাঝে ঘুরতে থাকে-- সবাই এত কিছু করে, এত দম্ভ অহংকার, সবাই কি আসলেই এত অসাধারণ? সবাই কি করে পারে? আমি তেমন কিছুই করতে পারিনি। যা হয়েছে, তা আমার জানা ছিল না, হয়ে গেছে। এমন করে কত কিছুই করি, করতে চাই। হয়ত কিছু হয় বা হয়না। কত কিছু আপনাতেই হয়, তাও আমি জানিনা, বুঝিও না।

কিছু একটা হয়ে যাবার অপেক্ষায় দিন গুণে চলি... শুক্রবার, শনিবার... নভেম্বর ডিসেম্বর... ২০১২, ২০১৩... এই অপেক্ষা হয়ত শেষ হবেনা। দুই পাশে শুণ্য পেতেই হয়ত তার আগেই চিরবিদায়। কে জানে তার কথা? সে তো তখন হয়ত হয়েই যাবে, আমি করবো না।

তাল সামলানোর অন্তহীন এক যুদ্ধ হলো জীবন

আমার প্রিয় দিনগুলো অতীতে। প্রতিটা দিন যায়, জ্ঞানের পরিধি বাড়ে, পৃথিবীর ঘটনাগুলো পরিষ্কার হতে থাকে। প্রতিটি সম্পর্কের পেছনে মানুষের অনেক জটিলতা থাকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের পেছনে অজস্র ঠগবাজি থাকে, প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে থাকে অনেক অসহায় মানুষের অর্থের উপরে।

চাকুরি করতে এসে খুব অস্থির লাগে। এই অনাচারে মন টিকেনা, তবু পেটের দায়ে আঁকড়ে ধরে থাকতে হয় প্রতিটি মিথ্যার মাঝেই নিজের জায়গাটুকু। এই নীতিবোধ কোত্থেকে তৈরি হয়েছিলো জানিনা। হয়ত বাবা-মায়ের জীবন দেখেই। পুরোনো সেই বোধগুলোর সাথে জীবনের ঘটনাগুলোকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণ এক এক করে হিসেব করতে থাকি, খেয়ালে বা বেখেয়ালে, অজান্তে আপনা আপনিই।


চাকুরি শেষে ফেরার সময় আজ আমার একটা স্মৃতি মনে পড়লো। সেই স্মৃতিতে ছিলো এক ঘণ্টা ধরে ট্রেন লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে যাবার স্মৃতি। সাথে ছিলো দুই বন্ধু। রেলের লাইনে তিনটা সমান্তরাল লাইনের ওপর তিনজনের হেঁটে যাওয়া। দূরে খেয়াল রাখতে রাখতে আমরা সেদিন পণ করেছিলাম -- কে দ্রুত না পড়ে একটা পাতের উপরে দিয়ে দূরে হেঁটে যেতে পারে।

তখনো সাধারণ বোধ হারাইনি, মনে ছিলো খেয়াল রাখতে হবে ট্রেন আসার ব্যাপারটা। দুইটা ট্রেন সিগন্যালের মাঝামাঝি জায়গায় একপাশে সবুজ ক্ষেত আর আরেকপাশে ঘরবাড়ির এলাকায় সেদিন হেঁটেছিলাম। তিনজনের মধ্যে আমিই সবার আগে পড়ে গিয়েছিলাম। দ্রুত ছিলাম না।


স্মৃতি আজ মনে পড়ে গেলো। কারণ এই শহরে শ্রম বেচে ফেরার সময় তো অমনই লাগে। আমি তাল পাইনা। ক্রমাগত পড়ে যেতে নিই। কোনমতে সামলাই। ভালো লাগেনা। খাঁচার ভেতর অচিন পাখির মতন মনে হয়। পরিবার সংসার ছেড়ে যেতে পারব না, পারব না বাউল হতে, পারব না সন্নাসী হয়ে বটগাছের নিচে বসে গান গাইতে। আসলে ওই জীবনগুলোরও অর্থ নাই।

এই তাল সামলানোর অন্তহীন এক যুদ্ধ হলো জীবন। এর শেষ কেবল একটা বাগানে গেলেই হবে। তার আগে শুধুই ছুটে চলা। তবে, চোখটা বন্ধ করে যখন তাকে অনুভব করি খুব কাছে, হৃদয়ের গভীরে, কেবল তখনই শান্তি পাই। নয়ত বুঝি টিকে থাকত পারতাম না এই জনারণ্যে - মিথ্যে, প্রবঞ্চনা, ঠাট-বাট, অত্যাচার আর অন্যায়ের এই শহরে। পড়ে যেতে নিয়ে তাই সামলে উঠি মাঝে মাঝে কিছু সুন্দর অনুভবে...

একদিন ছুটি হবে

একদিন ছুটি হবে,
অনেক দূরে যাব,
নীল আকাশে সবুজ ঘাসে,
খুশিতে হারাবো'

গানটা কেন যেন হঠাৎ করেই কানে ভাসছে। হয়ত সেই ছুটির দিনের নীল আকাশের সবুজ ঘাসে হারাতে মন চাইছে। আমার কি আর ভেসে যাওয়া হবে সেই নীল আকাশের নিচে? কই, কয়েকদিন আগেই তো গেলাম এক বিশাল সবুজ মাঠে আর নীল আকাশের নিচে। অথচ যখন এই গানটা শুনেছিলাম নতুন কুঁড়িতে মনে হয় -- তখন এমন করে যেতে পারিনি খুশিতে হারাতে। তখন আবেগ ছিল টাটকা, নিষ্কলুষ।


বয়স ঘুরে অনেক হলো। নিষ্কলুষ ভালোবাসা আর অনুভূতি আর নেই মনে হয়। একটা বয়েসে প্লেটোনিক না ফ্রয়েডীয় লাভ বেশি শক্তিশালী আর সঠিক -- তা নিয়ে তর্ক হত ফ্রেন্ড সার্কেলে। আমি সবসময়ে প্লেটোনিক লাভ টাইপের তৎকালীন কনসেপ্টে আসীন ছিলাম। সময় গেলো, বুঝলাম আমার কনসেপ্টটাই ভুল ছিল, আমি আসলে ডেফিনিশানই ভুল জানতাম। তবে, এখন জানি, যেই ভালোবাসার টানে পাশে আনে এয়ারটেল। ভ্যাসলিনের কোমলতার যেই ভালোবাসার বিকিকিনি হয় পথে প্রান্তরে -- সবই ফ্রয়েডিয় ভালোবাসা। কামাসক্ত ভালোবাসার প্রচার-প্রসার সর্বত্রই। এখন ভালোবাসা প্রেম শব্দগুলো যারা ব্যবহার করে -- তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের কিশোর বয়সের অশ্লীল জোকসগুলার কথা স্মরণ করে বিষ্ময়াভিভূত হয়ে ভাবি -- সবাই মনে হয় অনেক বদলে যায়। হয়ত বদলায় না, খোলস বদলায়, ভেতরের সেই পাশবিক দানবটা তো মরে যায়নি, নির্জনে সেই দানবটাই কি ওদের ভিতর থেকে বের হয়ে আসে না?

ইচ্ছে হয়না এইসব আলোচনায় থাকি। এই আলোচনা আমার হৃদয়কে বিষাক্ত করে। আমি সবসময় চেয়েছি সুন্দরকে জিইয়ে রাখতে। রাস্তার মোড়ে সুরুজ মিয়ার সবজির দোকানে প্রায়ই দেখি একবালতিতে পানি নিয়ে সবজিগুলোকে ক্রমাগত ভেজাতে থাকে। আমার কেন যেন তার এই প্রচেষ্টা দেখলেই নিজের কথা মনে হয়। আমিও তো অনেকবার চেয়েছি এরকম করে আমার সুন্দর স্বপ্নগুলোকে পানিতে ভিজিয়ে সজীব রাখবো। কই হলো!! সময়ের সাথে সাথে আমার ভালোবাসা, প্রেম, আর্তিগুলো কলুষিত হতে থাকে। আমি সমাজের আর দশজনের মতন নই। আমি একজন পরাজিত মানব। হিস্টেরিয়া আক্রান্ত রোগী দেখিনি, গল্প শুনেছি। এইসব বাস্তব নোংরা ঘটনাগুলো আমাকে হিস্টরিয়াগ্রস্ত করে ফেলতে নেয়। আমি আবার লুকাই। নিজের মাঝেই লুকায়। আমার আরেকটা কল্পনার জগত আছে। ওতে সাইন ইন করে ঢুকে পড়ি।

আমার একদিন ছুটি হবে ঠিক ঠিক। আমি জানি এই জগতের পর আরেকটা জগত আছে। আমি নিশ্চিত। আমি সৃষ্টির মাঝে অদ্ভুত সাম্য দেখতে পেয়েছি। পাইনি আমার স্বপ্নালোকে। আমার জীবনের স্বপ্নগুলো সবই অধরা। এটা হতে পারেনা। আমি কখনই আকাশে উড়তে চাইনি। ছোট ছোট কিছু পেতেও যখন অজস্র সময় অপেক্ষা করেছি তখনো বিনিময়ে পাইনি কিছুই। না পাওয়ার কথা বলতে চাইনা।

আমার একটা স্বপ্ন ছিল। আমার একটা হরিণ থাকবে। আমি একটা সুন্দর বনের মধ্য দিয়ে দৌড়ে যেতে থাকব। হরিণটা আমার পাশে পাশে থাকবে, দৌড়াবে। একসময় আমরা একটা ঝর্ণা দেখতে পাব। আমি দৌড়ে যখন ওখানে গিয়ে আঁজলা ভরে পানি খাবো, আমার হরিণটাও ওখানে গিয়ে মুখ ডুবিয়ে দিবে নালাতে। দু'জনে সেখান থেকে আবার দৌড়ে একটা বিশাল গাছের নিচে থামবো। আমি হ্যামক ঝুলিয়ে দিব, আমার গল্পের বই বের করে পড়তে শুরু করব।

আমার জীবনে এসব কিছু হয়নি, হবেওনা হয়ত। জগতের অনেকেরই এমন অনেক কিছু পূরণ হয়েছে। আমি ঝর্ণাও দেখিনি প্রায়। আমার বাকি আছে। আমাকে আমার স্রষ্টা অবশ্যই দিবেন। আমি তার কাছে পেতে অপেক্ষা করছি অনেক কিছুর অন্যায় ভোগ থেকে দূরে থেকে। একদিন আমার ছুটি হবে। বিশাল স্নিগ্ধ সবুজ বাগানে। আমরা ভাইবোনেরা সবাই ছুটে যাব এপ্রান্ত ওপ্রান্ত উচ্ছ্বাসে । আমি সেদিন চিতকার করে গাইবো --

'একদিন ছুটি হবে,
অনেক দূরে যাব,
নীল আকাশে সবুজ ঘাসে,
খুশিতে হারাবো'

০৬ জানুয়ারী ২০১৩, রাত ১২:০২ 

অপরাজিতা

সাদিয়া, তুমি শুনছ?
- হুঁ, বলো!
- তোমার কি অপরাজিতার কথা মনে আছে?
- তোমার ক্লাসমেট ছিলো, সেই মেয়েটা?
- হুমম। ও খুব সুন্দর কবিতা লিখত।
- বলেছিলে একবার মনে হয়।
- একবার শীতের সময়ে আমাদের ক্যাম্পাসে 'স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর ছিলো। অপরাজিতা পাঠ করেছিলো, 'রোদনের বসন্ত' নামের কবিতা।
- এ আবার কেমন শিরোনাম? অদ্ভুত তো!
- অদ্ভুতই বটে! অপরাজিতার শব্দচয়ন খুব সুন্দর ছিল। তোমার মতন নয় যদিও। তুলনা করছিনা। তবে তোমার লেখনী কোমল, আর অপরাজিতার শব্দগুলো খুব দৃঢ় গাঁথুনির ছিল।
- মনে আছে কোন পংক্তি?
- বলছি শোন :


আমার সকল উদাসীনতার নাম যদি দাও ঘৃণা,
তোমার বোধের প্রতিটি জোড়ে দিলাম তপ্ত করুণা।

- অপরাজিতাকে তোমার পছন্দ ছিল?
- ছিলো বৈকি। আমি কবিতাপ্রেমী ছিলাম, তুমি জানো।
- বলনি ওকে কখনো?
- কবিতা ভালোবাসলেই কবি ভালোবাসতে হবে বলে মনে করো তুমি?
- কবির হাতেই তো কবিতা আসে।
- কিন্তু কবিতা আমার অবসরের সঙ্গী ছিল। আমি তো চাইছিলাম জীবনসঙ্গী।
- তাহলে কীসের তোমার নির্লিপ্ততা এনেছিল?
- আমি কোমলভাষী মানুষ, শক্ত কথা আমার সয়না।
- আমি তো অনেক রূঢ় তুমি জানোনা?
- টের পাইনি এখনো।
- পাবে 'খন।
- তুমি পারবে না রূঢ় হতে। কঠিন সময়েও।
- এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?
- মনে হয় আমার। তুমি তো মহামহিমের প্রিয় হতে চাও। তুমি কী করে পারবে তোমার জীবনসঙ্গীকে রূঢ় ব্যবহার করতে।
- ভন্ডামি ছাড়ো। বাস্তবতায় কাব্য মানেনা। খেপে গেলে কি আর হুঁশ থাকে?
- আমি ভন্ডামি করিনি সাদিয়া। আমি জানি একজন মানুষের সবচাইতে খারাপ ব্যবহারটাই তাকে চেনায়। সময় তো কম যায়নি। আমার বাসার সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েও তুমি মাথা ঠান্ডা রাখতে পেরেছ দেখেই আমার ভয় কেটে গেছে। আমার সংকোচ ওটাই বড় ছিল।
- অপরাজিতারাও হয়ত পারে, সাদিয়াকে পেতে হলো কেন?
- আমি আসলে ওভাবে ভাবিই নি কখনো। প্রস্তত ছিলাম না জীবনের সবচাইতে বড় সিদ্ধান্তটার জন্য। কবিতা পাঠ করতে গিয়ে তখন অমন ভুল করে ফেললে বুঝি আফসোসে জীবন কেটে যেত।
- এভাবে বলনা। আর কেউ বুঝি জীবন কাটাচ্ছে না?
- সবার বুকের চাওয়া আর আর্তি কি এক? আমার চোখ পেরিয়ে যায় মৃত্যুর ওপারে। সফলতা আর সুখ তো ওপাশেই, তাইনা?
- এতক্ষণে কাব্যের ভ্রম কেটেছে তোমার।
- ভ্রমে থাকিনা আমি। কাব্য বলতে আমি বুঝি শব্দের বুনন। আমার কাছে কাব্যকে শীতের সকালে মাকড়সার জালে লেগে থাকা শিশির কণার মতন মনে হয়।
- এই অনুভূতিকে কী বল তুমি রিহাম? স্পর্শকাতরতা?
- বাহ! কী দারুণ করে বলে ফেললে। এই শব্দচয়নেই তোমার বিশেষত্ব।
- সে তো তোমার মনের প্রণয়াঞ্জনলিপ্ত মনের কথা, রিহাম। আমি নিজেকে চিনিনে বুঝি?
- ঠিকাছে। চুপ করে গেলুম। খুশি হলে তো?
- বেশ। হয়েছিই তো!

রঙ্গিন ফ্রেমের আড়ালে কিছু সাদাকালো অবহেলা

ইদানিং যেন খানিকটা টের পাই, সাহিত্য সৃষ্টির গোড়ায় কেমন জলের স্পর্শ থাকত। লেখকের হাত দিয়ে বেরিয়ে আসা দৃশ্যপট আর শব্দ সৃষ্টির পেছনে কোন অগ্ন্যুতপাত, তার খোঁজ কেউই জানতে পারেনা। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে অনেক শক্তি লাগে। সেই শক্তি আপনাতেই বিচ্ছুরিত হয়না। শক্তি বেরিয়ে আসে ভিন্ন চেহারায়, ভিন্ন আঙ্গিকে। শত-শত বার কেটেছে আমার, কলম ধরে এলোমেলো এঁকেছি, শব্দ পাইনি কলমের আগায়। কীবোর্ডে চেপেছি শব্দ, আবার পেছনে এসে মুছেছি। যা চেয়েছি, তা বের হয়নি বলেই এই মুছে দেয়া, মিটিয়ে ফেলা, কেটে ফেলা।


অনুভূতিদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অস্থিরতার একটা প্রকাশ থাকে লেখায়। কখনো থাকে সুবিন্যস্ত প্রকাশ। মাঝামাঝি কিছু হয় কি? আমি লিখছি সাহিত্যানুভূতি নিয়ে, অথচ খানিক আগেও কি সাহিত্য নিয়ে ভেবেছি? ক্ষয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়ার অদ্ভুত এক ঘোরের মাঝে কোত্থেকে সাহিত্য চলে এলো আর কেবল তখনই কিছু শব্দ বেরিয়ে এলো। হোক সেটা ছাইপাশ, শব্দ বেরিয়ে আসার এই অদ্ভুত বিষয়টা দেখেই ভাবছি -- লেখনী নির্ভর করে উনুনের জ্বালানীর উপরে। পাঠকরা হাঁড়ির সুস্বাদু খাবারগুলোকেই খেয়ে ফেলেন। অথচ এর পেছনে অনুভূতি আর চিন্তার জ্বালাগুলো উনুনে তীব্র দাহনের মতই থাকে। দাহ্য অনুভূতির হদিস কেউ নেয়না, পায়না। যারা শব্দের অর্থ বোঝে, যাদের হৃদয় থাকে, তারা হয়ত একশত জনে ১ জন বা তার চাইতেও কম -- কেবল তারাই অনুধাবন করতে পারেন যে প্রতিটি শব্দ সৃষ্টির পেছনে শক্তির প্রয়োজন হয়।

মাঝে মাঝে আমার খুব লিও তলস্তয়ের কথা মনে হয় এখনকার মতন করে। রেজারেকশন পড়েছিলাম, নেখলিউদভ আর কাতিউশার গল্প। বইটি তিনি লিখেছিলেন ১০ বছরে। একটা সাহিত্যের বুনন দশটি বছর ধরে দিন আর রাত লিখে যাওয়া -- এই অকল্পনীয় নির্ভোগ ত্যাগকে ক'জন অনুধাবন করেছেন? তলস্তয় একদিন মরে গিয়েছিলেন, তার মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল রেলস্টেশনের কুলিমজুরদের সাথে। মরে যাওয়ার আগে তিনি লিখেছিলেন ওয়ার এন্ড পিস, অ্যানা ক্যারোনিনা, রেজারেকশনের মতন কালজয়ী উপন্যাস। এই সৃষ্টিগুলোর পেছনে অমন কত ত্যাগ, কত যন্ত্রনা, কত অভিজ্ঞতা আছে -- কেউ কি কখনো ভেবে দেখে? কেউ কখনো চেষ্টা করে দেখে তার গভীরতা কতখানি ছিল?

খেয়েদেয়ে, ঘুমিয়ে, নির্ভার, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন-যাপনের পরে কারো দিকে চেয়ে থাকলে তাকে/তাদেরকে অসফল বলেই বোধ করে মানুষ। একদিন অবশ্য সবই উদঘাটিত হবে, প্রতিটি মিথ্যা আর মূর্খতা সেদিন উন্মোচিত হবে। সুখে থেকে ধারালো অস্ত্রের ন্যায় জিহবা নিয়ে ঘুরে বেড়ালে কেউ টের পায়না জগতের অন্য অজস্র মাত্রা থাকতে পারে। টেলিভিশনের ফ্রেমের মতন এই জগতে নিজ নিজ চিন্তার ফ্রেমের দিয়ে চেয়ে থাকা মানুষগুলো কখনই বুঝতে পারেনা সে এক ভ্রমের মাঝে বসবাস করে।

কবি ও কবিতা, উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিক জোড়ার জিনিসগুলো পুরাই ভিন্ন। কবিতা যতই মর্মস্পর্শী ও সুপাঠ্য হোক, পেছনের কবির হৃদয়ের অনুভূতিগুলোও তাকে সেইরকমেরই যন্ত্রণা দিয়ে তবেই শব্দ হয়ে বেরিয়ে এসেছে। ঔপন্যাসিকের চোখে এই সমাজ ও জগতের বিষয়গুলো ধারালো থেকে ধারালোতর হয়ে দেখা দিয়েছে বলেই সেই আঙ্গুল বেরিয়ে এসেছে এত জীবনদর্শন, দৃশ্যপট। পেছনের মানুষগুলোকে কেউ কোনদিন চিনতে পারেনি, পারেনা , চেষ্টাও করেনা -- এমন ভাবনাতে এসে বড্ড মন খারাপ হচ্ছিল।

মানুষ প্রচুর অনায্য ব্যবহার পায় চারপাশ থেকে, ক্রমাগত, আমৃত্যু।

২৭ জানুয়ারী ২০১৩, সকাল ১১:১০

কীইবা আসবে যাবে


অপরাজিতা বলেছিলো,
যেদিন সন্ধ্যায় আকাশ নীল লালের ডোরাকাটা হয়ে র'বে
যেদিন দুপুরে ঝুম বৃষ্টিতে ভেসে যাবে ধুলোমাখা রাজপথ।
যেদিন সকালে আকাশ কালো হয়ে অন্ধকার হয়ে রবে
যেদিন রাতে মূহুর্মুহু বিজলি চমকাবে, উত্তরাকাশে খসে পড়বে তারা।
সেদিন রাতে আমি তোমার জন্য প্রার্থনা করব, তুমি জেনে নিয়ো।

এই জটিল সমীকরণের অর্থ আমি বুঝিনি।
অপরাজিতা আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল কিনা জানা হয়নি।
যেদিন সকালে কালোমেঘ জমতো, সেদিন দুপুরে ঝুম বৃষ্টি হতনা।
যেদিন আকাশে তারাখসা দেখেছিলাম, সেদিন দুপুরে বৃষ্টি হয়নি।
হয়ত অপরাজিতা চায়নি আমি তার জন্য তার বাবার সামনে যাই
ঘরের কড়া নেড়ে চাচার হাত দু'টি ধরে বলি , "চাচা মেয়েটিকে আমায় দেন।
আমি আমার জীবনের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে ওকে সুখী করে অনন্তে সঙ্গী হতে চাই"।

অপরাজিতার কথা পত্রিকায় দেখেছি। সেরা রেজাল্ট করে আমেরিকা যাবার কথা ছিল।
মেসে থাকি,ছোট চাকরি। একটানা ব্যাঙ্ক ড্রাফট করে চাকুরির আশায় সিভি জমা দিই।
মাস শেষে বাজার আর রান্নার খরচার পরে মায়ের হাতে তেমন কিছু তুলে দেয়া হয়না।
অপরাজিতাকে পাওয়ার আকাঙ্খা ম্লান হতে থাকে। কেনই বা আসবে আমার ঘরে?
মাঝে মাঝে হেলাল হাফিজ পড়ি, ঝলসে যাওয়া অনুভূতিকে খুঁজে পাই শব্দের ভাঁজে ভাঁজে।

উপমা বান্ধবীর হয়ে খেপেছিলো, বুকের পাটা নেই তোমার?
যেতে পারনা ওদের বাসায়? কাপুরুষ নাকি? আমি নিরুত্তর থাকি।
চাচার সাথে পথে দেখা হয়েছিল আমার, কথাও হয়েছিল।
ভ্রূ-কুঞ্চিত বিরক্তির কথাগুলো আমার আজো মনে পড়ে।
সে কথা কাউকে বলিনি, উপমাকে না, শিহানকে না, সাকিবকেও না।
কী হবে বলে? কীইবা এসে যাবে জগতের এক যুবকের অসহায়ত্বে?
অশ্রুসিক্ত শার্ট শুকিয়ে যাবে একদিন। সময় গড়িয়ে যাবে।
বয়স পেরিয়ে যাবে। পথের ধারের কদম গাছটি বয়সের ভারে মরে যাবে।

কীইবা আসবে যাবে জগতের যদি নাইবা হয় স্বপ্নপূরণ,
কীইবা এসে যাবে এক যুবকের শূণ্যতায়।
যুঝতে যুঝতে তবু কিছু কাব্য লিখতে সে।
সেই কাব্যে আকাশ থাকত, নদী থাকত,
কখনো বক আর ফিঙ্গের কথা থাকত,
অপরাজিতা, নয়ন তারা আর গাঁদারও গল্প থাকত।
কোন এক নারীর কথোপকথন থাকত, কল্পনায়।

কীইবা এসে যাবে যদি আকাশে তারা নাইবা খসে,
ঝুম বৃষ্টি নাইবা হয়। অকালে মরে যায় কেউ।
কীইবা হবে ক্লান্ত প্রাণের অশ্রুমালায়।
সবই বয়ে যায় আপন নিয়মে।
স্রষ্টার সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য এই নির্বিকার জগতে।
কিছুই হয়না, কিছুই আসবে না, কিছুতেই কিছু হবেনা।
সময় বয়ে যাবে আপন মহিমায়, শেষ দিনের মহাভাঙ্গন অবধি।

০২ ফেব্রুয়ারী ২০১৩, দুপুর ০১:২৩ 

12 March 2013

ফেসবুক কি তরুণ-তরুণীদের প্রেমকুঞ্জ?

এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ার কথা জানলাম কয়েকদিন আগে। মফস্বলের মেয়ে। সদ্য ইন্টার পাশ করা তরুণী। তারও ফেসবুক আছে। পড়ার চাপ নাই, হাতে প্রচুর সময়। ভাইয়ের ল্যাপটপ ইউজ করে। ফেসবুকে তার অনেক বন্ধু আছে। তারা প্রায়ই নাকি তাকে 'প্রপোজ' করে। "কি যে খারাপ হয় ছেলেরা!" আচ্ছা, সে কি করে? প্রচুর অচেনা অজানা ছেলেদেরকে ফ্রেন্ড লিস্টে অ্যাড করেছে। যেটুকু জানি, সে তাদের সাথে চ্যাটিং-ও করে নিয়মিত।

একজন অবিবাহিতা প্রাপ্তবয়ষ্ক সুন্দরী/মানানসই তরুণী তার সময় কাটাতে নেটে ছেলেদের সাথে চ্যাটিং করতেই পারে, এবং ফলশ্রুতিতে অনেক প্রপোজ পেতেই পারে। ফেসবুকে চ্যাট করতে বসে ছেলে বনাম মেয়েরা কি নিয়ে আলাপ করে? দেশ-বিদেশ? সংস্কৃতি? দর্শন? ইতিহাস? অর্থনীতি? আপনার কি মনে হয় পাঠক? এই জগতে কয়জন আছে এরকম উন্নত চিন্তার? খুবই কম। আফটার অল, থাকলেও তারা আলাপচারিতায় আবেগীয় গল্পই করবে --এটাই স্বাভাবিক।



বাংলাদেশের পরিবারগুলাতে মেয়ে আর ছেলেরা বড় হয়ে যায় ধ্যাঙ্গা-ধিঙ্গি টাইপের। তাদের হাতে ইন্টারনেট থাকে, তাদের ফেসবুক থাকে। ভাই-বোন-বান্ধবীদের বিয়েতে সাজুগুজু করা ছবি প্রোফাইল পিকচার থাকে। এইরকম ছবিওয়ালা মেয়েদের অ্যাড করতে নব্বই শতাংশ ছেলে ভাবে না। তাদের বিবাহের কোন সম্ভাবনাই থাকে না। বিলবোর্ডে আর বিজ্ঞাপনে শুধুই প্রেম আর প্রেম। নাটকে আর সিনেমাতে শুধুই প্রেম আর প্রেম। মেয়ে সুন্দরী, অ্যাট্রাকটিভ --- ছেলেরা ম্যানলি, ফ্রেঞ্চকাট, টাইট জামা, প্যাক ওয়ালা বডি।

বেশিরভাগ সময়ে এইসব ফ্লাটারিং প্রিয় মেয়েদের ছবিগুলা ছেলেদের কম্পিউটারে জমা হয়। আমি একটা ছেলেকে চিনি, যার কম্পিউটারে হাজার হাজার ফেসবুক মেয়েদের ছবি ছিল আজ থেইকা কয়েক বছর আগেই। তার একাকীত্বের খাবার ছিল এইসব ছবি, সেইটা কাছের ফ্রেন্ডদের অনেকেই জানত।

আদর্শ নাই, মোটিভেশন নাই, কাজ নাই, বিবাহ নাই, সম্পর্ক নিয়া জ্ঞান নাই, আছে যৌবনের চাওয়া, মনের চাওয়া, দিলের চাওয়া -- ফেসবুকে বন্ধু হও, কী দিয়া ভাত খাইছ সেই গল্প করো, কই কই সাজতে যাও, কার গান শুনো, তোমার বন্ধুরা তোমাকে সময় দেয়না তারা খারাপ এইসব কথা বলো।

এরপর একদিন বলাবলি হবে,

আম্মু আমাকে বকেছে।
-- ক্যানো, রাগ কইরো না।
আমার মন খারাপ।
-- গান শুনো। মন ভালো হবে
শুনতেসি। হাবীব-ন্যান্সির গান
-- বাহির বলে দূরে থাকো?
হ্যা। আমার অনেক ভাল্লাগে এইটা।
....
....
ব্লা ব্লা
....
....
-- তোমাকে একটা কথা বলি?
কি?
-- তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।
এ হয়না
-- কেন? ভালোবাসা তো স্বর্গীয়। ব্লা ব্লা ব্লা


[এরপর চলতে থাকি বলিউডি সিনেমায় দেখা ডায়লোগ, অথবা স্টার জলসার ডায়লোগ। একসময় এগুলো নিয়ে গ্যাঞ্জাম হয়। ফোনের টেপ ছড়ায়। দেখাদেখি হলে ছবি তুলাতুলি হয়। সেইগুলা ফোনে করে বন্ধুদের দেখায় ছেলেটা, বান্ধবীদের দেখায় মেয়েটা। এরপর একদিন ফ্যামিলি বাধ সাধে। বাপ মা খারাপ হয়। নইলে আরো অনেক খারাপ কিছু হয়। একান্ত ঘুরতে গিয়ে কত কীইতো হয়]


আমরা আমাদের ঘরের পুত্রকন্যাদের খবর রাখি তো? শাসন করে নতুন প্রজন্মের কেশাগ্রও যে বৃদ্ধ সম্প্রদায় কামাতে পারবেন না, সেই বিষয়ে নিঃসন্দেহ থাকা যায়। অভিভাবকত্ব জিনিসটা কত কঠিন সেইটা টের পাই। সেই সাথে ইডিয়ট পুরুষ ও মহিলারা যখন অভিভাবক হয় --তাদের প্রোডাকশন সন্তানগুলা হয় ইতর এবং অভদ্র। পরিবারের পিতামাতার চরিত্র ও আদর্শ, ভাইবোনের চরিত্র ও আদর্শ অন্যদেরকে প্রভাবিত করে।

কিন্তু সেই সাথে সবচাইতে বেশি দরকার --- মোটিভেশন, ইন্সপিরেশন।

এই মূহুর্তে আপনার ঘরের কিশোর-কিশোরীদের ভালোবাসা কি নিয়ে? তাদের কি সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাপারে ঝোঁক আছে? তারা কি জানে জীবনের উদ্দেশ্য কি? তারা কি এই ভারতীয় ছিনেমাতে ভেসে যাচ্ছে? বলিউডি গানে কি তার দিন কাটে? সুস্থ সংস্কৃতিকে তৈরি করার জন্য কাজ না করুন, আপনার অন্তত প্রার্থনা আছে তো? যারা বিকল্প কিছু সৃষ্টিতে এগিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকে নষ্ট বলে গালি দিয়ে গর্তে না ঢুকে অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন তো?

না হলে অপেক্ষা করতে থাকুন একটা দিনের। হয়ত আপনি বা আপনার পরিবার শীঘ্রই পত্রিকার পাতার একটি দুর্ঘটনার খবর হয়ে যেতে পারে। নইলে আজই জেগে উঠুন। নিজে বাঁচুন, পরিবারকে বাঁচান।


২৯ জানুয়ারী ২০১৩, সকাল ১১:০০

11 March 2013

ম্যারী এ্যান, গর্ভধারিণী, প্রেমকথা

২৩ ডিসেম্বর ২০১২, সন্ধ্যা ০৭:০০


♫♫ কালো সাহেবের মেয়ে ইশকুল পালিয়ে
ধরতে তোমার দুটো হাত
কত মার খেয়েছি মুখ বুজে সয়েছি
অন্যায় কত অপবাদ/
বয়স তখন ছিলো পনেরো তাই ছিলো
স্বপ্ন দেখার ব্যারাম
মাথার ভেতর ছিলো এলভিস প্রিসলি
খাতার ভেতর তোমার নাম/
ম্যারী এ্যান
ম্যারী ম্যারী এ্যান
ম্যারী এ্যান ম্যারী♫♫


আরিফের মাথায় ঘুরেই চলেছে গানের লাইনগুলো। গতকাল মারুফের বাসায় গিয়ে গানটা শুনলো। গানটা ক্লাস ফাইভে থাকতে শুনেছিলো পাশের বাসার আশরাফ ভাইয়ের ক্যাসেট প্লেয়ারে। তখন এরকম মোবাইলে গান বাজতো না। দুই স্পিকারের বড় ক্যাসেটে গান শুনতে আরিফ আশরাফ ভাইয়ার রুমে যেত। মাঝে মাঝে গ্লাসে করে পানি নিয়ে খাওয়াতে হত ভাইয়াকে। বিনিময়ে গান শুনতে পাওয়া যেত।

অনেক বছর আগের কথা সেটা। মারুফ কালকে আবার গানটা মনে করিয়ে দিল। ম্যারি অ্যান কোন কালো মেয়ে কে জানে। আরিফের বারবার মনে হচ্ছিলো, গানের জগতে কেউ মনে হয় পেয়ে ধন্য হয়না। না পাওয়া অনুভূতিরাই গান আর কবিতার জন্ম দেয়। "সুরঞ্জনা, যেয়ো নাকো তুমি, বলো নাক কথা ওই ছেলেটির সাথে" -- সেখানেও সুরঞ্জনা ধরা দেয়নি কবির কাছে। বনলতা সেনকে পেলে হয়ত জীবনবাবুর কবিতা লেখা হত না। লাবন্যকে পায়নি বলেই অমিতের কাব্য আরও নতুন মাত্রা পাওয়া।

আরিফের বই পড়তে ভালো লাগে। লেখকরা গভীর থেকে জীবনকে উপলব্ধি করতেন, কবিরাও করতেন। তাদের চিন্তাভাবনা আসলে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যবিহীন ছিলো, তাই সেখানে কবিতা পড়ে অস্থির লাগে সবারই। না পাওয়ার গল্প, গান তাই বিখ্যাত হয়। সবাইই বঞ্চিত থাকে। পাঠকরা আরো বেশি বঞ্চিত। মুভিতে নায়করা নায়িকাদেরকে পায়। তাদের পেতে হয়না। পাওয়ার আগেই সবকিছু হয় মুভিতে। হাতে হাত ধরে গান, বাহুবন্ধনে গাঢ় নিঃশ্বাস, সৌন্দর্য আর আভিজাত্য ঠিকরে পড়া মুভি-সিরিয়াল দেখে তাই ক্লাসের অভি-নীনিতা, শুভ্র-আরিয়ানা আনন্দে মাতাল হয়ে আছে। প্রতিদিন ওরা একসাথে এখানে ওখানে ঘুরতে যায়।


হাতে আরিফ আজকে গর্ভধারিণী নিয়ে বসে আছে, কানে গানটা। একটু আগে গুগল করে বের করলো এটা অঞ্জন দত্তের গান -- ম্যারি এন। আরিফের মিতুর কথা মনে পড়লো। পনের বছর বয়েসে মিতুকে ওর অপ্সরীর মতন লাগত। মিতুকে স্কুল থেকে নেমে বাসায় মেইন গেট ঢোকার পথটুকু দেখতে পেত বারান্দা দিয়ে। গায়ক ম্যারি অ্যানের হাত ধরলেও, আরিফের পক্ষে মিতুর হাত ধরতে সাহস দূরে থাক, কোনদিন কথা বলাও হয়নি। লজ্জা লাগত। মারুফ একদিন নাকি রাস্তায় কলেজ থেকে ফেরার সময় কথা বলতে চেয়েছিল। চাঁছাছোলা উত্তর পেয়ে মারুফ 'সুন্দরী রোবট' বলে ঘোষণা দিয়েছিল মিতুকে।

সাত-পাঁচ ভেবে পড়তে শুরু করে আরিফ। জয়িতার গল্প পড়ছে। জয়িতা-আনন্দ-কল্যাণ-সুদীপদের কাহিনী। জয়িতাকে বেশ ভালো লাগছে। মেয়েলি ঢং ছাড়া একটা মেয়ে। মিতুকেও ভালো লাগত। জয়িতার সাথে মিতুর মিল নেই বেশি একটা। মিতুর শারীরিক গঠন অনেক মেয়েলি ছিল। বইতে পড়ে বুঝতে পারছে, জয়িতা অনেক টিংটিঙ্গে রোগা। এরকম মেয়ে বলেই হয়ত অনেক সমাজ নিয়ে ভাবছে জয়িতা, বাবার অন্যায়কেও সহ্য করছে না। নইলে সুদীপ-আনন্দদের মতন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছেলেদের কারো সাথে ওর প্রেম শুরু হয়ে যেতে পারত।

মারুফ ইদানিং খুব প্রেম করছে। কাল ফেসবুক থেকে একটা মেয়ের সাথে চ্যাটিং করে ফোন নাম্বার জোগাড় করলো। এফএনএফ নাম্বার ফাঁকা ছিলো তাই তার আফসোস ছিলো, দু'জনেই এখন এয়ারটেল ইউজার। মারুফের আনন্দ দেখে অস্থির লাগে আরিফের। অভি, শুভ্রদের মতন এখন থেকে মনে হয় মারুফের গল্পও জামাকাপড়-গায়কগায়িকা-ফ্রাইড চিকেন হয়ে যাবে।

আরিফের মন খারাপ হয়। ম্যারি এন নামের কোন এক কালো মেয়ের মতন করে হয়ত ওর ছেলেবেলার মিতু একসময় বৃদ্ধা হয়ে যাবে। আরিফের আরো অনেকের কথা মনে হয় -- ওরাও কি এমন করেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হবে না? ম্যারিএনকে নিয়ে গান লেখা হলো -- সেই ম্যারিএন তো কোন সুখ পায়নি, টাইপ করে নখ খয়ে গিয়েছিলো। সৌন্দর্য হারিয়ে গিয়েছিলো অল্প ক'টা বছর পরেই।

আরিফের আরো মন খারাপ হয়। বইতে মন দেয় আরিফ। আনন্দের মা-কে খুব ভালো লাগে আরিফের। ওর মা এমন না। ওর ফ্যামিলিটা কল্যাণদের মতন। হাত-পা বাঁধা জীবন। বাসায় ক্যাচালের যন্ত্রণায় এই গল্পের বইটাই আরিফের একমাত্র প্রশান্তি, অবসরের বন্ধু। কালকে ক্লাসে জেরিন জিজ্ঞাসা করছিলো আরিফকে, "আরিফ, তুমি এত মনমরা থাক কেন?" আরিফ আরো লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল, বুকের কষ্ট দলা পাকিয়ে গিয়েছিল। সে জানে, তার কথা জেরিনকে বলা যাবে না। জেরিনের দিকে তাকানো যায়না টাইপের সুন্দরী মেয়ে। গত টার্মে জেরিনদের হলের সামনে গিয়ে ওকে নোট দিয়ে আসতে গিয়ে চুলখোলা জেরিনকে বের হতে এসে দেখেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো আরিফের। এরপর থেকে জেরিনকে এড়িয়ে চলে আরিফ। সামাজিক ব্যবধান অনেক, জেরিন ওর পারিবারিক অবস্থান জেনে ফেললে হয়ত এই দামটুকুও আর দিবেনা।

হঠাৎ একটু অস্থির লাগে আরিফের। কেমন যেন। সন্ধ্যা হলো মাত্র। কী করবে বুঝতে পারছে না। মারুফদের বাসায় যাবে কিনা ভাবতে গিয়ে খেয়াল হলো মনে হয় ফোনে কথা বলছে এখন, ফোন দিয়ে ট্রাই করে দেখে সেটাই -- কল ওয়েইটিং!! বাসায় ভাই-ভাবী আবার ঝগড়া শুরু করেছে। একটু পরে এখানে মা ঢুকবে -- চিতকার শুরু হবে। একটু শান্তি পেতে ইচ্ছা করে আরিফের। কেউ একটু গল্প কি করবে না ওর সাথে? এই মুহুর্তের একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতাকে অনুভব করে খুব অসহায় লাগে আরিফের। হাত-পা বাঁধা একজন কয়েদির কি এমনই লাগে?

মিশরের প্রেসিডেন্ট মুরসি ক্ষমতা গ্রহণের পর অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন

২৬ জুন ২০১২, বিকেল ০৫:৪৫ 

নির্বাচনে জয়লাভের পর সাধারণত একজন প্রেসিডেন্টের জীবন পাল্টে যায়। আলীশান বাসভবনে থাকার ব্যবস্থা, অফিসে-আদালতে তার ছবি টাঙ্গানো, পথে যাতায়াতের সময় সমস্ত যানবাহন থামিয়ে প্রেসিডেন্টের গাড়ির বহর যায়, আগে যেসব মানুষ কাছাকাছি থাকতেন আর দেখাসাক্ষাত করতেন তারাও প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে পারেন না গার্ডদের কড়াকড়িতে। আগের মানুষ আর প্রেসিডেন্ট মানুষ বদলে যায় অনেক বেশি।

মিশরের ইসলামিক রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রাক্তন নেতা, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডক্টর মুহাম্মাদ মুরসি দ্বায়িত্ব গ্রহণের পরেই এইসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।


তিনি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী আশা-জাগানিয়া যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো হলোঃ

ডক্টর মুরসি বলেছেন তিনি তার বর্তমান বাসভবনেই থাকবেন এবং প্রেসিডেন্টের আলিশান বাসভবনে তিনি ও তার পরিবার উঠবেন না।

প্রেসিডেন্ট মুরসি বলেছেন তার ছবি যেন সরকারী অফিস এবং প্রতিষ্ঠানগুলোতে লাগানো না হয়।

তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী ইউনিয়ন ও অর্গানাইজেশনগুলো যেন তার প্রেসিডেন্সি উপলক্ষে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অর্থ এবং সময়ের অপচয় না করে।

রিপাবলিকান গার্ডদের মুরসি জানিয়ে দিয়েছেন যে, পথে যাতায়াতের সময় যেন সাধারণ মানুষের পথরোধ করে তাদের কষ্ট দেয়া না হয়। তিনি আর একজন মিশরের জনগণ হিসেবেই চলাচল করতে চান।

বিপ্লবে নিহত মানুষদের পরিবারকে তার দপ্তরে দেখা করতে যেন রক্ষীরা কখনো বাধা না দেয়।




আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ডক্টর মুরসির ভূমিকাও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারীঃ

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানালে তিনি তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা সিরিয়ার সরকারের কাছ থেকে কোন অভিনন্দন গ্রহণ করবো না কারণ এই সরকার সিরিয়ান মিলিটারির প্রতিনিধিত্ব করছে যারা অবিচারে সিরিয়ার হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করছে।

মিশরে নিযুক্ত ইরানের রাস্ট্রদূতের সাথে ডক্টর মুরসি সাক্ষাত করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে তাদের জানানো হয় যতদিন ইরান সিরিয়ার প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি না বদলাবে, ততদিন মিশরের প্রেসিডেন্ট ইরানের সাথে তার এই অবস্থান পরিবর্তন করবেন না।

আত্মপ্রত্যয়ী, চমৎকার আশা-জাগানিয়া একটি শুরু করেছেন মুরসি। দেখা যাক ইসলামি রাজনীতি থেকে ক্ষমতায় যাওয়া এই প্রেসিডেন্ট আগামী সংকটময় দিনগুলোতে কতটুকু করতে পারেন মিশরের রাজনীতিতে।

চলে গেলেন মহীয়সী নারী উস্তাদা মারিয়াম জামিলাহ

আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন একজন মহীয়সী নারী, মারিয়াম জামিলাহ। মারিয়াম জামিলাহ নিউ ইয়র্ক সিটিতে জার্মান বংশোদ্ভূত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৩৪ সালের ২৩ মার্চ। তার নাম রাখা হয়েছিল মার্গরেট মারকাস। তিনি কৈশোরেই জুদাইজম এবং অন্যান্য ধর্মবিশ্বাস নিয়ে আগ্রহী ছিলেন এবং পড়াশোনা করেন। সত্যের প্রতি ও জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থেকেই তিনি ১৯৬১ সালে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন। তিনি তিরিশটির বেশি বই লিখেছেন। আল্লাহর দ্বীনের জন্য আজীবন ত্যাগ স্বীকার করা জ্ঞানী, গুণী এই মানুষটি ২০১২ সালের ৩১ অক্টোবর আল্লাহর সুবহানাহু ওয়া তা'আলার ডাকে পাড়ি জমান পৃথিবী ছেড়ে।


মারিয়াম জামিলাহ বেড়ে ওঠেন সেকুলার পরিবেশে। তিনি নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ধর্মের প্রতি আগ্রহবোধ করেন। তার নিজস্ব পরিবেশে ধর্মশিক্ষার কোন নির্দেশনা না পেয়ে তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি জানতে আকৃষ্ট হন। তার এই আগ্রহ ও আকর্ষণ তাকে অনেকগুলো ধর্মের বিষয় জানতে, বিভিন্ন ধর্মের গভীরের তাৎপর্য জানতে সাহায্য করে। হাই স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি এশিয়ান এবং বিশেষ করে আরব কালচারের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। আরব এবং ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলের অত্যাচার ও অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করতেন তার পরিচিতজনদের কাছে তখন থেকেই। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, তিনি হলোকাস্টের ছবি থেকে ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-কষ্টের প্রতি আগ্রহী হন, পরবর্তীতে একটি ইহুদীবাদী তরুণ গ্রুপে যান এবং অবশেষে ইসলামের মৌলিক ধারার প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯৫৪ সালে তিনি ইসলাম-এর সাথে পরিচিত হন।


মারিয়াম জামিলাহ মারমাদুক পিস্কথালের কুরআনুল কারীমের অনুবাদ পড়ে মুগ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি মুহাম্মাদ আসাদের 'রোড টু মক্কা' পড়ে অনুপ্রাণিত হন। মুহাম্মাদ আসাদও ইসলামে ফিরে আসা একজন ইহুদি পরিবারে জন্ম নেয়া মানুষ ছিলেন। উস্তাদা মারিয়াম জামিলাহ পরবর্তীতে মুহাম্মাদ আসাদের এই বইটিকে তার ইসলামে ফিরে আসার পেছনে প্রভাব রেখেছিল বলে উল্লেখ করেন।


ইসলাম নিয়ে তার এই পড়াশোনার ফলে তিনি বন্ধনে জড়িয়ে পড়েন আর তার বিশ্বাসের একজন মুখপাত্র হয়ে পড়েন। তিনি ইসলাম গ্রহণের আগেই ফিলিস্তিনের প্রতি পাশ্চাত্যের মানসিকতার বিরুদ্ধে কথা বলেন, মুসলিম বিশ্বাস নিয়ে পাশ্চাত্যের ভ্রান্ত সমালোচনার বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকেন -- যা তার ব্যক্তিগত জীবনকে অশান্ত করে তোলে। তবু তিনি সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে সাথে নিয়েই তার প্রতিবাদ অক্ষুণ্ণ রাখেন।

১৯৬১ সালের ২৪ মে তিনি নিউ ইয়র্ক শহরে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর দক্ষিন আফ্রিকার ডারবান থেকে প্রকাশিত পত্রিকা মুসলিম ডাইজেস্টে তিনি লেখালেখি শুরু করেন। এই জার্নালে লেখালেখির সময় উস্তাদা মারিয়াম জামিলা সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদীর চিন্তাধারার সাথে পরিচিত হন, যিনিও একই পত্রিকায় লিখতেন। তিনি আবুল আলা মওদূদীর চিন্তায় অনুপ্রাণিত হন এবং তার পাশ্চাত্য এবং ইসলাম নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা মাওলানার সাথে শেয়ার করেন। সেই চিঠিগুলো পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশিত হয়।

উস্তাদা মারিয়াম জামিলাহ ১৯৬২ সালে পাকিস্তানে পাড়ি জমান ইসলামের প্রতি ভালোবাসায়। পেছনে তার পরিবার-পরিজনসহ সবকিছুকে ত্যাগ করে আসেন দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে এবং তার সাধ্যমতন কাজ করে যেতে। তিনি পাকিস্তান জামায়াত-ই-ইসলামির একজন নেতা, মুহাম্মাদ ইউসুফ খানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পাকিস্তানে আসার পর থেকে অনেক লেখালেখি করতে থাকেন। তার চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্যই হলো আধুনিক বিশ্বের এই প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য এবং মুসলিম সভ্যতার দ্বন্দ্বগুলো নিয়ে এবং তার গভীরতম বিষয়গুলো নিয়ে। তিনি নিজে পাশ্চাত্য এবং ইহুদি বিশ্বাস ও চেতনার পরিবেশে বেড়ে ওঠা বলে তার এই উপলব্ধি অত্যন্ত গভীর আর সূক্ষ্ম।


মারিয়াম জামিলাহ তার জীবনে দু'হাত ভরে লিখে গেছেন। ইসলামিক মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতি নিয়ে তিনি অজস্র বই লিখেছেন যা অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বৈপ্লবিক। এই মহীয়সী নারীর মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় -- বিগত কয়েক দশক ধরে আমরা ক্রমাগত ইসলামের আলোয় আলোকিত মুক্তার মতন ঝলমলে প্রাণগুলোকে হারাচ্ছি এই পৃথিবী থেকে। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাদের জীবনকে কবুল করে নিন। উস্তাদা মারিয়াম জামিলাহর বর্ণাঢ্য ও ত্যাগে ভরা জীবনকে কবুল করে তাকে যেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা জান্নাতুল ফিরদাউসের উচ্চ মর্যাদা দান করেন।


তাঁর লেখা প্রায় তিরিশটি বইয়ের কয়েকটি হলো -
1. ISLAM VERSUS THE WEST
2. ISLAM AND MODERNISM
3. ISLAM IN THEORY AND PRACTICE
4. ISLAM VERSUS AHL AL KITAB PAST AND PRESENT


সূত্রঃ

১) উইকিপিডিয়া : মারিয়াম জামিলাহ
২) বই - ইসলাম ভার্সাস দি ওয়েস্ট / বায়োগ্রাফি অংশ
৩) মারিয়াম জামিলাহ -- সাহিত্যকর্মের উপরে তৈরি ব্লগ