28 November 2012

মিশরের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মুসলিম ব্রাদারহুড এবং প্রেসিডেন্ট মুরসির বিগত পাঁচ মাস : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

মিশরে একটা উত্তাল সময় চলছে। প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ মুরসি আরেকটি জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। হোসনি মুবারকের ৩২ বছরের শাসনামলের পতনের পর থেকেই কিছু শাসনযন্ত্রীয় জটিলতায় ভুগছে মিশর। প্রকান্ড সেইসব সমস্যা নিয়ে একটি দেশের প্রশাসনকে চালু রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে। তবে ইতিমধ্যে তিনি সমস্ত সমস্যাই সফলতার সাথেই অতিক্রম করেছেন।  মার্কিনী ও ইসরাইলিদের বন্ধুসুলভ সরকার ছিলো হোসনি মুবারকের প্রশাসন। ভৌগলিক কারণে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির কারণেও মিশর সবার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।



২৫ জানুয়ারির সেই আন্দোলনের পর মুবারকের পতন অনিবার্য হয়ে যায়। সেই বিক্ষোভ ও আন্দোলনে সকলেরই অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। পরবর্তীতে দেশে নির্বাচন হয় এবং নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুড মুভমেন্টের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টি (এফজেপি) সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করে এবং সালাফি আল-নূর পার্টির সাথে পার্লামেন্ট গঠন করে। সেই সময়ে হোসনি মোবারক ক্ষমতা ছেড়ে দিলেও প্রশাসনের সমস্ত ক্ষেত্রেই ছিল মোবারকপন্থী লোক। তখন দেশের সর্বময় ক্ষমতা ছিলো SCAF সুপ্রিম কাউন্সিল অফ আর্মড ফোর্সেস এর হাতে, যার প্রধান ছিল ফিল্ড মার্শাল হুসেইন তানতাওয়ি, মোবারকের একনিষ্ঠ সহযোগি। দীর্ঘকাল চড়াই উতরাই পেরিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এগিয়ে আসে, সুপ্রিম কাউন্সিল আয়োজন করে নির্বাচনের। কিন্তু নির্বাচন পূর্ববর্তী বিভিন্ন রকম নিয়মকানুনে প্রেসিডেন্ট পদের প্রতিযোগিতা থেকে বাদ পড়েন অত্যন্ত জনপ্রিয় সালাফি নেতা শায়খ হাজেম সালাহ আবু ইসমাইল এবং মুসলিম ব্রাদারহুদের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও প্রখ্যাত ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খায়রাত আল শাতের। ফ্রিডম এন্ড জাস্টিস পার্টির হয়ে দ্বিতীয় নমিনেশন ছিলেন ডক্টর মুরসি। 

আন্দোলন করে একনায়কের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করা জনগনের সামনে তখন ছিলো মূলত চারজন প্রতিযোগি -- ব্রাদারহুডের নির্বাচিত মুহাম্মাদ মুরসি, ব্রাদারহুড থেকে প্রত্যাখ্যাত অপর নেতা আব্দুল মুনিম আবুল ফুতুহ, বামপন্থী সেকুলারদের পছন্দ আমর মুসা এবং মোবারকের সময়ে প্রধানমন্ত্রী আহমেদ শফিক। আবুল ফুতুহ এবং আমর মুসার জনপ্রিয়তা খুব একটা ছিলো না। দেশের জনগনের সামনে ছিলো মূলত দু'টি পছন্দ -- আহমেদ শফিক এবং মুহাম্মাদ মুরসি। অকল্পনীয়ভাবে ভোটের ফলাফলে আহমেদ শফিককে এগিয়ে থাকতে দেখে আঁতকে ওঠে জনগণ। তবে, এখানে ব্রাদারহুডের কাজ ছিলো সুনিপুণ এবং সূক্ষ্ম। প্রতিটি কেন্দ্রে ছিলো তাদের উপস্থিতি, যারা কেন্দ্রের ফলাফলগুলোর রেফারেন্স কপি প্রমাণসহ রেখে তারা কেন্দ্রীয়ভাবে রক্ষনাবেক্ষন করে ফেলে। যেকোন সরকারি বেসরকারী সংগঠন ফলাফল হিসেব করতে বসার আগেই ব্রাদারহুদের রাজনৈতিক দল এফজেপির পক্ষ থেকে নির্বাচনী ফলাফলের একটি বই প্রকাশ করা হয়ে যেখানে ৫১ ভাগ ভোট এককভাবে পেয়েছিলেন ড মুরসি। নিয়মানুযায়ী প্রেসিডেন্টকে অবশ্যই ৫০% এর বেশি ভোট পেতেই হবে। যদিও আহমেদ শফিক ভিন্ন প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর চেষ্টা করেছিল এবং তার পক্ষেই ছিল মিশরের ক্ষমতার উৎস সুপ্রিম কাউন্সিল অফ আর্মড ফোর্সেস। তবু শেষ পর্যন্ত সেই ষড়যন্ত্র নস্যাত হয়ে যায় কিছু ঐতিহাসিক মূহুর্তের কাছে।  ফলাফল প্রকাশের দিন জনগণ আতঙ্কিত ছিল। আহমেদ শফিকের কাছে প্রেসিডেন্সি যাওয়া মানে আবার সেই পুরোনো চক্রে হারিয়ে যাওয়া মিশরের মানুষের চাওয়া পাওয়া। সেদিন তাহরির স্কয়ারে মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে সকাল থেকেই। ফলাফল প্রকাশের পর চিৎকার করে ওঠে সারাদেশ, হয়ত সারাবিশ্বেই। মুরসির প্রেসিডেন্সিতে আবেগাপ্লুত হয়ে আনন্দিত হয়েছিল তখন দেশের সালাফি-ইখওয়ানি-সেকুলার-খ্রিষ্টান সকলের। এদিকে পার্লামেন্ট নিয়ে কিছু নাটকীয়তা হয়। পার্লামেন্ট নির্বাচনকে অকার্যকর ঘোষণা করে বিচারবিভাগ -- ফলে নতুন সংবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা পুনরায় সুপ্রিম কাউন্সিলের হাতেই থাকে। প্রেসিডেন্টকে পুতুল বানিয়ে ফেলার পথ তৈরি করার দিকে এগিয়ে যায় প্রশাসন। মুরসি সেই সময় বুদ্ধিমান ও চৌকস প্রেসিডেন্টের মতন হাল ধরেন। সুপ্রিম কাউন্সিল অফ আর্মড ফোর্সেস তাদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করার আগেই তার প্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাওয়ি এবং সেনাপ্রধান সামি আদনানকে অবসরে পাঠানো হয়। তবে তাদেরকে তিনি দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা 'অর্ডার অব নাইল' পদকে ভূষিত করেন এবং সুচারুরূপে পরিস্থিতি সামাল দেন সেনাবাহিনীর মাঝে অরাজকতা তৈরি হওয়াকে এবং সর্বোপরি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জটিলতা সৃষ্টি থেকে। সুপ্রিম কাউন্সিল অফ আর্মড ফোর্সেস এর নতুন প্রধান করা হয় আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসি, যিনি একই সাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্বপালন করবেন।  এরপর দেশের অর্থনৈতিক এবং সামগ্রিক পুনর্গঠনে মন দেন মুরসি। ফিলিস্তিনে ইসরাইলের আক্রমণে প্রায় দুই শতাধিক প্রাণহানি হয় এক সপ্তাহে, মুরসি সতর্ক হুঁশিয়ারি দেন ইসরাইলকে, কূটনীতিবিদকে দেশে ফিরিয়ে আনেন ইসরাইল থেকে। পরবর্তীতে তার মধ্যস্থতায় ইসরাইল আক্রমণ বন্ধ করার চুক্তি করে হামাসের সাথে। এই কাজটি প্রশংসিত হয় সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কাছে।

এই সময়েই বিভিন্ন গোপন সূত্রে মুরসি প্রশাসনের কানে আসে বিচার বিভাগ প্রেসিডেন্টকে অকার্যকর ঘোষণা করে পুনরায় সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় আনবে। এরপরেই মুরসি ডিক্রি জারি করেন, যার মাধ্যমে তিনি বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তগুলো প্রেসিডেন্টের আওভাভুক্ত করেন। জেনারেল প্রসিকিউটর মেগুইদ মাহমুদকে তিনি প্রত্যাহার করেন। এই ডিক্রির ফলে প্রেসিডেন্টের হাতে বিশাল ক্ষমতা বিচার বিভাগের স্বেচ্ছাচারীতা আর সম্ভব নয়।  এই ডিক্রির পজিটিভ দিক হল -- এর ফলে মোবারকের সময়ে করা হতাকান্ডগুলোকে বিচারের আওতায় আনা যাবে। যা পূর্বে বিচারবিভাগ রহিত করে দিয়েছিল। ফলে পূর্বেকার হিসেবে মোবারক এবং তার প্রশাসনের সবাই বিচারের বাইরে চলে গিয়েছিল। হোসনি মোবারকের পতন আন্দোলনে জড়িত সবাই এই সিদ্ধান্তে আনন্দিত হয়েছে, আনন্দিত হয়েছে দেশবাসী, যা চলমান সকল জরিপেই দেখা যাচ্ছে। এই ডিক্রির ফলে পজিটিভ মতামত দিচ্ছেন বোদ্ধারা, কেননা এর ফলে মিশরে দীর্ঘদিন যাবত চলে আসা প্রেসিডেন্ট-প্রশাসন-বিচারবিভাগের ক্ষমতার গোলক-ধাঁধা একটি পরিচ্ছন্ন রূপ পাবে। 

প্রেসিডেন্ট মুরসি এবং তার প্রশাসন জানাচ্ছেন প্রেসিডেন্টের এই ক্ষমতা কেবলই অল্প সময়ের জন্য নেয়া হয়েছে, যা কেবল বিবাদমান জটিল পরিস্থিতির সমাধানের জন্য। মিশরের রাজনৈতিক বোদ্ধা এবং সমালোচকরা এই সিদ্ধান্তকে বলিষ্ঠ ও বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে করছেন। তবে এরপরেও দেশে ভাংচুর হচ্ছে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক দল এফজেপির অফিসগুলো। অরাজক পরিস্থিতিকে উসকে দিচ্ছে বামপন্থী সেকুলার কিছু দল, যার মনে করছে এই ক্ষমতা ইসলামিক দলগুলোর হাতে চলে গেলো।

এছাড়া মোবারকের মদদপুষ্ট বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে থাকা লোকেরাও এই ডিক্রি ঘোষনার পরবর্তী সহিংসতায় উসকানিমূলক ভূমিকা রাখছে। শেষ খবর জানা পর্যন্ত, প্রেসিডেন্ট মুরসি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন, আলোচনার জন্য তিনি বিচারবিভাগের উর্ধতন অনেকের সাথে সংলাপের জন্য ডাক দিয়েছেন।  মোটকথা, মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির একটা কন্ট্রোল মিশরের উপরে হওয়ায় দেশের এবং বাইরের অজস্র শত্রুভাবাপন্ন, কূটকৌশলী ও কূটনৈতিক সমস্যাকে মোকাবেলা করে, ইসলামি রাজনীতি নিয়ে শত্রুভাবাপন্ন আরেক জনগোষ্ঠিকে বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে মোকাবেলা করে তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার কঠিক কাজটি করতে হবে প্রেসিডেন্ট মুরসিকে। তার সামনের সময়কে সহজ বলা যাবে না। তবে, মুসলিম ব্রাদারহুড এবং এফজেপি এখন পর্যন্ত বিগত দু'বছর ধরে প্রায় সবক্ষেত্রেই রাজনৈতিক কৌশলে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। আগামীতে কীভাবে তারা এই পরিস্থিতিকে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে মোকাবেলা করে -- তা দেখার বিষয়। 


 সাম্প্রতিক লিঙ্কঃ দি অ্যারাবিস্ট আর্টিকেল - ইসান্দার আল আরমানির লেখা 

No comments:

Post a Comment