28 November 2012

গাজায় কেন সৈন্য পাঠাচ্ছেন না প্রেসিডেন্ট মুরসি? : মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে একটি পর্যালোচনা

গাজায় ক'দিন ধরে চলছে চরম মানবিক সংকট। প্রায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি, হাজার হাজার মানুষ বোমার আঘাতে হাসপাতালে আহত। রিফিউজি হিসেবে ফিলিস্তিনি মাটিতে পা দেয়া ইহুদিরা ইসরাইল নামের রাস্ট্র গঠন ও তাকে টিকিয়ে রাখার পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতেই ফিলিস্তিনিদের উপরে এই সামরিক হামলা বলে মনে করেন অনেকে। সেনা, নৌ ও শক্তিশালী বিমান হামলায় বিপর্যস্ত গাজাবাসীর জীবন।

এই পরিস্থিতিতে মুসলিম বিশ্ব থেকে উল্লেখযোগ্য কোন সাহায্য দেখা যায়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে অঙ্গুলিনির্দেশ যাচ্ছে মিশরের প্রেসিডেন্ট ডক্টর মুহাম্মাদ মুরসির প্রতি। কেন তিনি প্রতিবেশি রাস্ট্র হয়েও কোন সামরিক শক্তি প্রয়োগ করলেন না।  এই প্রসঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা মনে রাখা প্রয়োজন -- মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকা আবশ্যক একজন মুসলিমের।
আরব রাস্ট্রগুলোর বেশিরভাগ রাস্ট্রই রাজতন্ত্রের মত ব্যবস্থায় ছিল এই শতাব্দীর শুরুতেও। মিশর, তিউনিশিয়া এবং লিবিয়াতে একনায়ক সরকার ছিলো হোসনি মুবারক, বেন আলী এবং মুয়াম্মার গাদ্দাফি। মুবারকের সময়ে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে রাজনৈতিক জুলুম-পীড়ন পোহাতে হয়েছে ইসলামি মুভমেন্ট করার জন্য। আন নাহদা মুভমেন্ট এর অবস্থাও একই ছিলো তিউনিশিয়াতে। তিউনিশিয়ার মসজিদে বয়স্ক মানুষদের ছাড়া কারো ঢোকার ব্যাপারেও ছিলো কড়া সতর্কতা সরকারী বাহিনীর দিক থেকে। লিবিয়াতে গড়ে ওঠেনি গণমানুষের কোন চেতনা, গাদ্দাফির একক শক্তিতে ৪১ বছরের রাজত্ব ছিলো। সিরিয়ায় বাসার আল আসাদ এবং তার পিতা হাফিজ আল আসাদ উনিশশত সত্তর সাল থেকেই একনায়কতন্ত্র জারী রেখেছিল -- সেখানে জনগণের চিন্তার প্রতিফলন থাকার প্রশ্নই উঠেনা। 

বেন আলীর পতন হয় ফলবিক্রেতা বোয়াজিজি একনায়ক সরকারের প্রতিবাদে গায়ে আগুণ ধরিয়ে আত্মহননের পরের আন্দোলনে। এই আন্দোলনের বাতাস যায় মিশরের তাহরীর স্কোয়ারে। বছর ধরে প্রচুর উত্থান পতনের পর সামরিক সরকারের আশ্রয়ে ও শক্তিতে জারি থাকা হোসনি মুবারকের পতন হয়। মিশরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পেরিয়ে এসেছিলো বিশাল এক পথ পরিক্রমা। এরপর নির্বাচন হয়, এতে হোসনি মোবারকপন্থী সামরিক বাহিনীর প্রবল বিরোধি শক্তি প্রয়োগ সত্বেও চরম নাটকীয়তার পর মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা ডক্টর মুহাম্মাদ মুরসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। এর আগে তিউনিশিয়াতে আন নাহদা মুভমেন্ট সাফল্যের মুখ দেখে, শাইখ রাশিদ আল ঘানুশির দক্ষ নেতৃত্বে জনগনের ভোট পেয়ে আন নাহদা কোয়ালিশন করে সরকার গঠন করে তিউনিশিয়ায়। অনেকেই এই পরিবর্তনকে আরব বসন্ত বলছেন। 

এর পূর্বের ইতিহাসের কথাও মনে রাখা জরুরি। এই সুদীর্ঘ সময়ে, বিশেষ করে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড হাসান আল বান্নার নেতৃত্বে মুভমেন্ট শুরু করার পরবর্তী ৮০ বছরের প্রায় পুরোটাই আন্দোলনের নেতাকর্মীরা জুলুম ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে পেরিয়ে আসে। সাইয়েদ কুতুব, জায়নাব আল গাজালিদের মতন অজস্র ত্যাগ স্বীকার করে ইখওয়ানের নেতাকর্মীরা। জামাল আব্দুল নাসের এবং তারপর হোসনি মোবারকের ক্ষমতার সময়ে জনমত গড়ে তোলা নিষিদ্ধ করে রাখা মুসলিম ব্রাদারহুডের জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ ছিল, তবু তারা তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কাজ জিইয়ে রেখেছিল, যোগ্যতা বৃদ্ধি করেছিল বুদ্ধিবৃত্তিক, আধ্যাত্মিক। এই সুদীর্ঘ সময়ে দেশের সবগুলো সেক্টরকেই সেকুলারাইজড করার চেষ্টা করা হয় -- যেমন সেকুলারাইজড করা হয়েছিল তুরস্কে কামাল আতাতুর্কের শাসনামলে।  আরবের অন্যান্য দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে বেশ কয়টা কারণে যার মধ্যে অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা এবং সরকার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা গুরুত্বপূর্ণ দু'টি বিষয়। বাদশাহ ফয়সাল তেল পাইপলাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাণ উড়ে গিয়েছিলো। ফলশ্রুতিতে সূক্ষ্ম চালে তাকে হত্যা করা হয়, সৌদি আরবেও শক্তিশালী সত্যভাষী নির্ভীক শাসক আর দেখা যায়না। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রগুলোর সবাই আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ককে গুরুত্বের সাথে দেখে। মিশর, তিউনিশিয়ায় চলমান জনপ্রিয় সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্র দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে আদর্শিক দিক থেকে সমপর্যায়ের দুইটি মুভমেন্ট মুসলিম ব্রাদারহুড এবং আননাহদার ফসল হিসেবে।

এই অবস্থায় এই দুইটি রাস্ট্রকেই অনেক গভীরে গেঁথে থাকা সেকুলার সোসাইটি এবং সেকুলার রাজনৈতিক দলগুলোর সৃষ্টি করা ক্রমাগত রাজনৈতিক সংকটকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। সেই সাথে ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সামলাতে হচ্ছে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে -- মিশরের এই সেনাবাহিনী গড়ে উঠেছিলো দেশের একনায়কের হাতকে শক্তিশালী করার নিমিত্তে। যখন কেউ বলবে, এই সেনাবাহিনী যুদ্ধ করবে ইসরাইলি বাহিনীর সাথে, যারা বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী, যাদের বিলিয়ন ডলারের অর্থ সাহায্য আসে যুক্তরাস্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ইউরোপ থেকে, তখন একটা বিষয় মাথায় রাখা জরুরি -- এই সেনাবাহিনী গড়েই উঠেছে ইসরাইলি রাস্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করতে এবং মুসলিম ফিলিস্তিনি রাস্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করার স্পিরিটে। যে বা যারা এই সুস্পষ্ট বিষয়টাকে আমলে না নিয়ে কথা বলেন, নিঃসন্দেহে সেনাবাহিনীর স্পিরিট নিয়ে গড়ে ওঠার বিষয়টাতে তারা অজ্ঞ  ইদানিংকালে অনেকেই জিহাদ ঘোষণা নিয়ে একটা তর্ক করছিলেন, তাদের ধারণাই থাকেনা হয়ত যে যুদ্ধের একটা পরিকল্পনা থাকতে হয়। ইসলাম শত্রুর সামর্থ্যের দিকে না তাকিয়ে যুদ্ধ করলেও -- আত্মহননে উদ্বুদ্ধ করে না। অ-ইসলামিক মিশরীয় বাহিনীর সাথে অ-ইসলামিক স্পিরিটে গড়ে ওঠা আর কোন বাহিনীই কোন অবস্থাতে এই যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে পারবে না। এই বাহিনীকে গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ। কেবলমাত্র জিহাদি প্রেরণায় গড়ে ওঠা কতিপয় সংগঠন অনেক দেশেই বিরাজমান যারা এইসব ক্ষেত্রে এরদোগান আর মুরসির দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে -- যদিও সকল ক্ষেত্রেই তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গালাগালি দেয়। তাদেরকে এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আর অবাস্তব আবেগ থেকে বেরিয়ে এসে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা করা জরুরি। 

প্রেসিডেন্ট মুরসি গাজাতে হামলা হবার প্রথম দিনেই ইসরাইল থেকে রাস্ট্রদূত ডেকে পাঠিয়েছেন, পরিষ্কার গলায় হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসরাইলকে -- এই দৃশ্যও তো এতদিন এই বিশ্ব দেখতে পায়নি।  আমার মনে হয়, এই মূহুর্তে হামলা বন্ধ করার ব্যাপারে যদি তিনি ভূমিকা রাখেন এবং গাজাবাসী ফিলিস্তিনিদের কাছে ক্রমাগত খাদ্য ও চিকিৎসা সেবা যাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিতকরনের সাথে সাথে অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্য নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে আর্থিক, নৈতিক সমর্থন নিতে পারেন -- এই মূহুর্তে এটা একটি বড় প্রাপ্তি হবে। মুসলিম উম্মাহর একজন নেতা হিসেবে মুহাম্মাদ মুরসির কাছে সবাই বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী পদক্ষেপ দেখতে চায়। 

প্রকৃতপক্ষে, ইহুদিবাদকে উৎপাটন করতে ও রুখতে প্রয়োজন বুদ্ধিবৃত্তিক, অর্থনৈতিক, সামরিক শক্তি। আধ্যাত্মিক বা স্পিরিচুয়াল উন্নতির আবশ্যকতাও তো অনস্বীকার্য। আমার মনে হয় সামগ্রিক উন্নতি ও প্রস্তুতির সেই সময় অবধি অপেক্ষা করা প্রয়োজন ইসরাইলকে উচ্ছেদের। যদিও এই পথ অবশ্যই অনেক বন্ধুর আর কঠিন হবে।  আশাবাদী কথা হলো, ক'দিন আগে সুদানে সারাবিশ্বের মুসলিম নেতৃবৃন্দের বৈঠক হয়েছে -- মুসলিম ব্রাদারহুডের জেনারেল গাইড ডক্টর মুহাম্মাদ বদি, তিউনিশিয়ার আননাহদা মুভমেন্টের নেতা রাশিদ আল ঘানুশি, হামাসের খালেদ মিশাল, পাকিস্তান জামাআতের সাইয়েদ মুনাওয়ার হাসানসহ সমগ্র বিশ্বের শতাধিক নেতা একত্রিত হয়েছিলেন -- কথা বলেছেন বিশ্ব পরিবর্তন নিয়ে, উম্মাহকে নিয়ে তারা একসাথে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। পরিবর্তন আসছে এই পৃথিবীতে, সময়ের ব্যাপার মাত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।

No comments:

Post a Comment