21 March 2013

রঙ্গিন ফ্রেমের আড়ালে কিছু সাদাকালো অবহেলা

ইদানিং যেন খানিকটা টের পাই, সাহিত্য সৃষ্টির গোড়ায় কেমন জলের স্পর্শ থাকত। লেখকের হাত দিয়ে বেরিয়ে আসা দৃশ্যপট আর শব্দ সৃষ্টির পেছনে কোন অগ্ন্যুতপাত, তার খোঁজ কেউই জানতে পারেনা। প্রতিটি সৃষ্টির পেছনে অনেক শক্তি লাগে। সেই শক্তি আপনাতেই বিচ্ছুরিত হয়না। শক্তি বেরিয়ে আসে ভিন্ন চেহারায়, ভিন্ন আঙ্গিকে। শত-শত বার কেটেছে আমার, কলম ধরে এলোমেলো এঁকেছি, শব্দ পাইনি কলমের আগায়। কীবোর্ডে চেপেছি শব্দ, আবার পেছনে এসে মুছেছি। যা চেয়েছি, তা বের হয়নি বলেই এই মুছে দেয়া, মিটিয়ে ফেলা, কেটে ফেলা।


অনুভূতিদের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অস্থিরতার একটা প্রকাশ থাকে লেখায়। কখনো থাকে সুবিন্যস্ত প্রকাশ। মাঝামাঝি কিছু হয় কি? আমি লিখছি সাহিত্যানুভূতি নিয়ে, অথচ খানিক আগেও কি সাহিত্য নিয়ে ভেবেছি? ক্ষয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়ার অদ্ভুত এক ঘোরের মাঝে কোত্থেকে সাহিত্য চলে এলো আর কেবল তখনই কিছু শব্দ বেরিয়ে এলো। হোক সেটা ছাইপাশ, শব্দ বেরিয়ে আসার এই অদ্ভুত বিষয়টা দেখেই ভাবছি -- লেখনী নির্ভর করে উনুনের জ্বালানীর উপরে। পাঠকরা হাঁড়ির সুস্বাদু খাবারগুলোকেই খেয়ে ফেলেন। অথচ এর পেছনে অনুভূতি আর চিন্তার জ্বালাগুলো উনুনে তীব্র দাহনের মতই থাকে। দাহ্য অনুভূতির হদিস কেউ নেয়না, পায়না। যারা শব্দের অর্থ বোঝে, যাদের হৃদয় থাকে, তারা হয়ত একশত জনে ১ জন বা তার চাইতেও কম -- কেবল তারাই অনুধাবন করতে পারেন যে প্রতিটি শব্দ সৃষ্টির পেছনে শক্তির প্রয়োজন হয়।

মাঝে মাঝে আমার খুব লিও তলস্তয়ের কথা মনে হয় এখনকার মতন করে। রেজারেকশন পড়েছিলাম, নেখলিউদভ আর কাতিউশার গল্প। বইটি তিনি লিখেছিলেন ১০ বছরে। একটা সাহিত্যের বুনন দশটি বছর ধরে দিন আর রাত লিখে যাওয়া -- এই অকল্পনীয় নির্ভোগ ত্যাগকে ক'জন অনুধাবন করেছেন? তলস্তয় একদিন মরে গিয়েছিলেন, তার মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল রেলস্টেশনের কুলিমজুরদের সাথে। মরে যাওয়ার আগে তিনি লিখেছিলেন ওয়ার এন্ড পিস, অ্যানা ক্যারোনিনা, রেজারেকশনের মতন কালজয়ী উপন্যাস। এই সৃষ্টিগুলোর পেছনে অমন কত ত্যাগ, কত যন্ত্রনা, কত অভিজ্ঞতা আছে -- কেউ কি কখনো ভেবে দেখে? কেউ কখনো চেষ্টা করে দেখে তার গভীরতা কতখানি ছিল?

খেয়েদেয়ে, ঘুমিয়ে, নির্ভার, নির্ঝঞ্ঝাট জীবন-যাপনের পরে কারো দিকে চেয়ে থাকলে তাকে/তাদেরকে অসফল বলেই বোধ করে মানুষ। একদিন অবশ্য সবই উদঘাটিত হবে, প্রতিটি মিথ্যা আর মূর্খতা সেদিন উন্মোচিত হবে। সুখে থেকে ধারালো অস্ত্রের ন্যায় জিহবা নিয়ে ঘুরে বেড়ালে কেউ টের পায়না জগতের অন্য অজস্র মাত্রা থাকতে পারে। টেলিভিশনের ফ্রেমের মতন এই জগতে নিজ নিজ চিন্তার ফ্রেমের দিয়ে চেয়ে থাকা মানুষগুলো কখনই বুঝতে পারেনা সে এক ভ্রমের মাঝে বসবাস করে।

কবি ও কবিতা, উপন্যাস এবং ঔপন্যাসিক জোড়ার জিনিসগুলো পুরাই ভিন্ন। কবিতা যতই মর্মস্পর্শী ও সুপাঠ্য হোক, পেছনের কবির হৃদয়ের অনুভূতিগুলোও তাকে সেইরকমেরই যন্ত্রণা দিয়ে তবেই শব্দ হয়ে বেরিয়ে এসেছে। ঔপন্যাসিকের চোখে এই সমাজ ও জগতের বিষয়গুলো ধারালো থেকে ধারালোতর হয়ে দেখা দিয়েছে বলেই সেই আঙ্গুল বেরিয়ে এসেছে এত জীবনদর্শন, দৃশ্যপট। পেছনের মানুষগুলোকে কেউ কোনদিন চিনতে পারেনি, পারেনা , চেষ্টাও করেনা -- এমন ভাবনাতে এসে বড্ড মন খারাপ হচ্ছিল।

মানুষ প্রচুর অনায্য ব্যবহার পায় চারপাশ থেকে, ক্রমাগত, আমৃত্যু।

২৭ জানুয়ারী ২০১৩, সকাল ১১:১০

No comments:

Post a Comment