11 March 2013

ম্যারী এ্যান, গর্ভধারিণী, প্রেমকথা

২৩ ডিসেম্বর ২০১২, সন্ধ্যা ০৭:০০


♫♫ কালো সাহেবের মেয়ে ইশকুল পালিয়ে
ধরতে তোমার দুটো হাত
কত মার খেয়েছি মুখ বুজে সয়েছি
অন্যায় কত অপবাদ/
বয়স তখন ছিলো পনেরো তাই ছিলো
স্বপ্ন দেখার ব্যারাম
মাথার ভেতর ছিলো এলভিস প্রিসলি
খাতার ভেতর তোমার নাম/
ম্যারী এ্যান
ম্যারী ম্যারী এ্যান
ম্যারী এ্যান ম্যারী♫♫


আরিফের মাথায় ঘুরেই চলেছে গানের লাইনগুলো। গতকাল মারুফের বাসায় গিয়ে গানটা শুনলো। গানটা ক্লাস ফাইভে থাকতে শুনেছিলো পাশের বাসার আশরাফ ভাইয়ের ক্যাসেট প্লেয়ারে। তখন এরকম মোবাইলে গান বাজতো না। দুই স্পিকারের বড় ক্যাসেটে গান শুনতে আরিফ আশরাফ ভাইয়ার রুমে যেত। মাঝে মাঝে গ্লাসে করে পানি নিয়ে খাওয়াতে হত ভাইয়াকে। বিনিময়ে গান শুনতে পাওয়া যেত।

অনেক বছর আগের কথা সেটা। মারুফ কালকে আবার গানটা মনে করিয়ে দিল। ম্যারি অ্যান কোন কালো মেয়ে কে জানে। আরিফের বারবার মনে হচ্ছিলো, গানের জগতে কেউ মনে হয় পেয়ে ধন্য হয়না। না পাওয়া অনুভূতিরাই গান আর কবিতার জন্ম দেয়। "সুরঞ্জনা, যেয়ো নাকো তুমি, বলো নাক কথা ওই ছেলেটির সাথে" -- সেখানেও সুরঞ্জনা ধরা দেয়নি কবির কাছে। বনলতা সেনকে পেলে হয়ত জীবনবাবুর কবিতা লেখা হত না। লাবন্যকে পায়নি বলেই অমিতের কাব্য আরও নতুন মাত্রা পাওয়া।

আরিফের বই পড়তে ভালো লাগে। লেখকরা গভীর থেকে জীবনকে উপলব্ধি করতেন, কবিরাও করতেন। তাদের চিন্তাভাবনা আসলে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্যবিহীন ছিলো, তাই সেখানে কবিতা পড়ে অস্থির লাগে সবারই। না পাওয়ার গল্প, গান তাই বিখ্যাত হয়। সবাইই বঞ্চিত থাকে। পাঠকরা আরো বেশি বঞ্চিত। মুভিতে নায়করা নায়িকাদেরকে পায়। তাদের পেতে হয়না। পাওয়ার আগেই সবকিছু হয় মুভিতে। হাতে হাত ধরে গান, বাহুবন্ধনে গাঢ় নিঃশ্বাস, সৌন্দর্য আর আভিজাত্য ঠিকরে পড়া মুভি-সিরিয়াল দেখে তাই ক্লাসের অভি-নীনিতা, শুভ্র-আরিয়ানা আনন্দে মাতাল হয়ে আছে। প্রতিদিন ওরা একসাথে এখানে ওখানে ঘুরতে যায়।


হাতে আরিফ আজকে গর্ভধারিণী নিয়ে বসে আছে, কানে গানটা। একটু আগে গুগল করে বের করলো এটা অঞ্জন দত্তের গান -- ম্যারি এন। আরিফের মিতুর কথা মনে পড়লো। পনের বছর বয়েসে মিতুকে ওর অপ্সরীর মতন লাগত। মিতুকে স্কুল থেকে নেমে বাসায় মেইন গেট ঢোকার পথটুকু দেখতে পেত বারান্দা দিয়ে। গায়ক ম্যারি অ্যানের হাত ধরলেও, আরিফের পক্ষে মিতুর হাত ধরতে সাহস দূরে থাক, কোনদিন কথা বলাও হয়নি। লজ্জা লাগত। মারুফ একদিন নাকি রাস্তায় কলেজ থেকে ফেরার সময় কথা বলতে চেয়েছিল। চাঁছাছোলা উত্তর পেয়ে মারুফ 'সুন্দরী রোবট' বলে ঘোষণা দিয়েছিল মিতুকে।

সাত-পাঁচ ভেবে পড়তে শুরু করে আরিফ। জয়িতার গল্প পড়ছে। জয়িতা-আনন্দ-কল্যাণ-সুদীপদের কাহিনী। জয়িতাকে বেশ ভালো লাগছে। মেয়েলি ঢং ছাড়া একটা মেয়ে। মিতুকেও ভালো লাগত। জয়িতার সাথে মিতুর মিল নেই বেশি একটা। মিতুর শারীরিক গঠন অনেক মেয়েলি ছিল। বইতে পড়ে বুঝতে পারছে, জয়িতা অনেক টিংটিঙ্গে রোগা। এরকম মেয়ে বলেই হয়ত অনেক সমাজ নিয়ে ভাবছে জয়িতা, বাবার অন্যায়কেও সহ্য করছে না। নইলে সুদীপ-আনন্দদের মতন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছেলেদের কারো সাথে ওর প্রেম শুরু হয়ে যেতে পারত।

মারুফ ইদানিং খুব প্রেম করছে। কাল ফেসবুক থেকে একটা মেয়ের সাথে চ্যাটিং করে ফোন নাম্বার জোগাড় করলো। এফএনএফ নাম্বার ফাঁকা ছিলো তাই তার আফসোস ছিলো, দু'জনেই এখন এয়ারটেল ইউজার। মারুফের আনন্দ দেখে অস্থির লাগে আরিফের। অভি, শুভ্রদের মতন এখন থেকে মনে হয় মারুফের গল্পও জামাকাপড়-গায়কগায়িকা-ফ্রাইড চিকেন হয়ে যাবে।

আরিফের মন খারাপ হয়। ম্যারি এন নামের কোন এক কালো মেয়ের মতন করে হয়ত ওর ছেলেবেলার মিতু একসময় বৃদ্ধা হয়ে যাবে। আরিফের আরো অনেকের কথা মনে হয় -- ওরাও কি এমন করেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হবে না? ম্যারিএনকে নিয়ে গান লেখা হলো -- সেই ম্যারিএন তো কোন সুখ পায়নি, টাইপ করে নখ খয়ে গিয়েছিলো। সৌন্দর্য হারিয়ে গিয়েছিলো অল্প ক'টা বছর পরেই।

আরিফের আরো মন খারাপ হয়। বইতে মন দেয় আরিফ। আনন্দের মা-কে খুব ভালো লাগে আরিফের। ওর মা এমন না। ওর ফ্যামিলিটা কল্যাণদের মতন। হাত-পা বাঁধা জীবন। বাসায় ক্যাচালের যন্ত্রণায় এই গল্পের বইটাই আরিফের একমাত্র প্রশান্তি, অবসরের বন্ধু। কালকে ক্লাসে জেরিন জিজ্ঞাসা করছিলো আরিফকে, "আরিফ, তুমি এত মনমরা থাক কেন?" আরিফ আরো লজ্জা পেয়ে গিয়েছিল, বুকের কষ্ট দলা পাকিয়ে গিয়েছিল। সে জানে, তার কথা জেরিনকে বলা যাবে না। জেরিনের দিকে তাকানো যায়না টাইপের সুন্দরী মেয়ে। গত টার্মে জেরিনদের হলের সামনে গিয়ে ওকে নোট দিয়ে আসতে গিয়ে চুলখোলা জেরিনকে বের হতে এসে দেখেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিলো আরিফের। এরপর থেকে জেরিনকে এড়িয়ে চলে আরিফ। সামাজিক ব্যবধান অনেক, জেরিন ওর পারিবারিক অবস্থান জেনে ফেললে হয়ত এই দামটুকুও আর দিবেনা।

হঠাৎ একটু অস্থির লাগে আরিফের। কেমন যেন। সন্ধ্যা হলো মাত্র। কী করবে বুঝতে পারছে না। মারুফদের বাসায় যাবে কিনা ভাবতে গিয়ে খেয়াল হলো মনে হয় ফোনে কথা বলছে এখন, ফোন দিয়ে ট্রাই করে দেখে সেটাই -- কল ওয়েইটিং!! বাসায় ভাই-ভাবী আবার ঝগড়া শুরু করেছে। একটু পরে এখানে মা ঢুকবে -- চিতকার শুরু হবে। একটু শান্তি পেতে ইচ্ছা করে আরিফের। কেউ একটু গল্প কি করবে না ওর সাথে? এই মুহুর্তের একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতাকে অনুভব করে খুব অসহায় লাগে আরিফের। হাত-পা বাঁধা একজন কয়েদির কি এমনই লাগে?

No comments:

Post a Comment