21 March 2013

কত কিছু যে হয়ে যায়

সবাই নাকি অনেক কিছু করে। বিশাল প্রতিষ্ঠান বানায়, অট্টালিকা বানায়, কেউ বানায় দেশ, কেউ বানায় জাতি, কেউ হত্যা করে পুরো জাতিকেই, কেউ বিশাল বড় মাফিয়া। কেউ কেউ বিজ্ঞানী, তারা অণুপরমাণূর ভিতরের হিজিবিজিও বের করে এনে পুরষ্কার নেন।

ছোট থেকেই আমি সব দেখি। দেখতে দেখতে ভাষা হারাই। আবেগগুলো আমার গভীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাকে, কিন্তু আমি তবুও নিজের কথা ভাবি। হাত-পা নাড়াতে না পারা, কথা বলতে না পারা হকিন্স কীভাবে লোহিত অপভ্রংশকে নিয়ে চিন্তা করতে করতে একসময় বিগব্যাং আবিষ্কার করলেন। এই তত্ত্বের না আছে, প্রমাণ না আছে তাকে অসার প্রমাণের শক্তি। তবু শক্তিশালী সেই তত্ব দেয়া লোকটা আমাদের ঢাকা শহরের সর্বনিম্ন পর্যায়ের প্রতিবন্ধীর মতন।

আমি এখনো দেখেই চলি। আমার সাথের ছেলেগুলো অনেক কিছুই আবিষ্কার করে ফেললো। কয়েকটি দেশের বিজ্ঞানীদের সেরা পুরষ্কার পেলো আমারই বন্ধুটা, একই সাথে একই জিনিস পড়লাম, ওর চাইতে আমি বেশি চিন্তা করতে পারতাম একটা সময় পর্যন্ত। তারপরের সময়গুলোই ইতিহাস লিখে দিলো। কেউ এই শহরে পচে মরে, কেউ বিশ্বজয় করে।

সবাই নাকি অনেক কিছু করে, অথচ আমি দেখলাম জীবনভর আমি কিছু করিনি। আমার যা অর্জন তা আমার নয় আসলে, এ সবই হয়ে গেছে। এই জীবনে কতকিছুই দরকার বুঝি। আজ থেকে অনেক কয়টা বছরা আগে যেই সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার ছিল -- বন্ধুরা সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবনে এগিয়ে গেছে। আমি আজো স্তব্ধ, পারিনা; আমার চারপাশ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আমার পক্ষে পারাও হবেনা। এই রকম বেড়াজাল আমাকে সামনে পেছনে টেনে রাখে। আমি নির্বিকার হয়ে বসে থাকি।

আমি জানি, কিছুই করিনা আমি। আমার ক্ষমতা কিছুই নেই। যখন অনেক কষ্ট হয় -- তখনো আমি আমার অসহায়ত্বকেই আবিষ্কার করি। যখন কিছু মিছু করে ফেললাম, সমগ্র অফিসে আমাকে নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো -- তখনো আমি জানি, সবাই যেটাকে ভালো বলছে, তার অনেক অনেক ভুল রয়ে গেছে, আমি তাকে উন্নত করতে পারিনি।

অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন ছিল। অথচ আমার শক্তি নেই সিদ্ধান্ত নেবার। হয়ত একদিন মাথা চাপড়াবো। জানিনা। সম্ভবত মাথা চাপড়াবো না। কেননা, ইতোমধ্যেই সেইরকম শত-সহস্র ভুল করে ফেলেছি। আমি জানি, আমার কিছুই করার ছিলো না। আসলে, হয়ত এই তীব্রতম যন্ত্রণাতেও মুখ বুঝে সহ্য করে যাওয়ার মাঝেই নিয়তি। হয়ত এই মুখ বুজে কাউকে শেয়ার না করাটাই আমার ভাগ্যলিখন। যতবার যতজনকেই বলতে গেছি, কেউই বুঝে নাই। আমার ভাগ্যবিধাতা আমাকে পথ করে দেন না। আমিও চুপচাপ থাকি। দুই জীবনের ধ্বংসকে চোখের সামনে এগিয়ে যেতে দেখি। আশাবাদী হতে চাই, আশাবাদী হতে হয়। বড় কোন অপরাধের সাহস পাইনা। আশা করার কোন অর্জনও নাই।

আমি তো আসলে কিছু করিনা। সবই আমার ইচ্ছেটুকুই। এখন যেই তীব্র ইচ্ছা, সেটা কখনো মুখ ফুটে বের হয়নি। যখন উচ্চারিত হলো, চারপাশের আকাশ ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্য দেখে বুঝেছিলাম -- আমার ক্ষমতা কল্পনাতীত কম। এই আকাশ তুলে স্থাপন করতে পারব না। পারব না নীল আকাশের মাঝে কোন রঙের আবির রাঙ্গাতে। আমার হাতে কিছুই নেই। সবই আমার ক্ষমতার অতীত।

এমনকি এই বাক্যগুলো লেখা? সেটার ইচ্ছাও আমার দু'দিন ধরেই ছিলো। কষ্ট জমতে জমতে যখন একটা এভারেস্ট হয়ে গেলো, তখন তাকে গলে পানির ধারা হয়ে ঝরতে শুরু করেছিলো চিন্তা। সময় আর সুযোগ হয়ে যখন লিখতে ধরলাম, তখনো তো অনেক ভাবনাই হারিয়ে গেছে। এটুকুও না হতে পারত। এটুকু হলেও বেশিকিছু হলো না, আবার কমও হলো না। গাজায় ছোট ছোট শিশুরা কাঁপছে বিমানের হামলার শব্দে, রোহিঙ্গারা হয়ত খোলা আকাশের নিচে শুয়ে, আমি যে কিছুই করতে পারিনা -- এই কষ্টগুলো এসব মানুষদের কথা ভাবলে লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যায়। পালিয়ে যেতে পারেনা, মিথ্যে তো না, কেবল চিন্তার কৌণিক পার্থক্য, সময়ের প্রবঞ্চনায়।

দিনশেষে একটা কথা মনের মাঝে ঘুরতে থাকে-- সবাই এত কিছু করে, এত দম্ভ অহংকার, সবাই কি আসলেই এত অসাধারণ? সবাই কি করে পারে? আমি তেমন কিছুই করতে পারিনি। যা হয়েছে, তা আমার জানা ছিল না, হয়ে গেছে। এমন করে কত কিছুই করি, করতে চাই। হয়ত কিছু হয় বা হয়না। কত কিছু আপনাতেই হয়, তাও আমি জানিনা, বুঝিও না।

কিছু একটা হয়ে যাবার অপেক্ষায় দিন গুণে চলি... শুক্রবার, শনিবার... নভেম্বর ডিসেম্বর... ২০১২, ২০১৩... এই অপেক্ষা হয়ত শেষ হবেনা। দুই পাশে শুণ্য পেতেই হয়ত তার আগেই চিরবিদায়। কে জানে তার কথা? সে তো তখন হয়ত হয়েই যাবে, আমি করবো না।

No comments:

Post a Comment